এইমাত্র পাওয়া

চাকরির বয়স ও শিক্ষার হাল: হাতে আছে মাত্র ১০ বছর

আমিরুল আলম খান।।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ৩৫ বছর করার দাবি জোরদার হচ্ছে। সেশন জট থেকে এ সমস্যার উদ্ভব। কিন্তু তারও চেয়ে বড় কারণ, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাওয়া। লক্ষণীয়, সরকারি চাকরিপ্রত্যাশীরা বিসিএস (অ্যাডমিন) ক্যাডার হতে বেশি আগ্রহী। তার কারণ, সাম্প্রতিক কালে এখানে ন্যায্য ও অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা—দুটিই অতিমাত্রায় বেড়েছে।

দেশে বিপুল সার্টিফিকেটধারী বেকারের সংখ্যা ক্রমেই টাইম বোমা হয়ে উঠছে। সতর্কতার এখনই সময়। আমাদের অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাসুবিধা থেকে ফায়দা নিতে হলে আমাদের হাতে সময় আছে খুবই কম, বড়জোর ২০৩০ সাল পর্যন্ত, মাত্র ১০ বছরের মতো। তারুণ্যসমৃদ্ধ বাংলাদেশ ২০৩০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দূরগামী হবে।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি প্রথম ওঠে ১৯৯০ দশকে। তখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। এরশাদ আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন জোরদারের জেরে সেশন জট শুরু হয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর তিন বছরের অনার্স কোর্স আট বছরেও শেষ হতো না। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতন হলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছর করার দাবি ওঠে। পরে সরকার সে দাবি মেনেও নেয়। পরবর্তীকালে সেশন জট কমলেও নানা কারণে এখন ৩৫ বছর করার দাবি জোরদার হচ্ছে। শিক্ষিত যুবকদের দাবিকে কি আমরা অন্যায্য বলতে পারি? আবার এ দাবি পূরণ করা হলে জাতির লাভ-ক্ষতি কী? এসব নিয়ে নির্মোহ বিতর্ক ও সমাধান হওয়া প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ১৮ বছরের নিচে কারও কোনো কাজে নিয়োগ পাওয়া বা নিয়োজিত হওয়া বেআইনি। কেননা, তা নিষিদ্ধ—শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। মানবশিশুর শারীরিক-মানসিক গঠন কর্মে নিয়োজিত হওয়ার উপযুক্ত হয় বয়স অন্তত ১৮ বছর। পূর্ববর্তী সময় হচ্ছে নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার কাল। এ বয়সে শিশুর অধিকার শিক্ষায়।

শিক্ষার শুরু প্রাথমিকে। সেটা বাল্যশিক্ষা। শিক্ষা পরিভাষায় তা এলিমেন্টারি বা বুনিয়াদি শিক্ষা। দেশে দেশে এর মেয়াদ ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশ, চীন ইত্যাদি দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। কোনো দেশে তা ষষ্ঠ, কোনো দেশে অষ্টম, কোথাও আবার নবম শ্রেণি পর্যন্ত। শিশুদের কৌতূহল বাড়িয়ে তোলা, তার কল্পনাকে সৃজনশীল কাজ হিসেবে উৎসাহিত করা এ পর্বে আসল শিক্ষা। তাই পাঠ্যবই আর প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার ভার যত কম রাখা যায়, ততই মঙ্গল।

কৈশোরিক শিক্ষা হলো মাধ্যমিক। আমাদের মতো অনেক দেশেই এখনো ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা। তবে অধিকাংশ উন্নত দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। এ পর্বে শিক্ষার উদ্দেশ্য ‘জীবিকার জন্য শিক্ষা’। মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো বিশাল এক কর্মী বাহিনী তৈরি করা, যারা নানা ধরনের বৃত্তিমূলক কাজে নিয়োজিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। বিশ্বব্যাপী বিশাল কর্মী বাহিনীর প্রান্তিক শিক্ষা হলো মাধ্যমিক। এ পর্বে শিক্ষা একমুখী ও বৃত্তিমূলক। একমুখী কথার অর্থ হলো সবাই মানবিক, সাধারণ বিজ্ঞান ও ব্যবসায় বিদ্যার অভিন্ন নির্যাস পাঠ করবে। শিক্ষা হবে হাতে–কলমে কাজ করে শেখা। সে শিক্ষা একই সঙ্গে দক্ষতা ও মানবিকতার। আধুনিক কালে বৃত্তিমূলক শব্দটি তত ব্যবহৃত হয় না। এখন বলা হচ্ছে কারিগরি ও প্রাযুক্তিক দক্ষতামূলক শিক্ষা। একই সঙ্গে তা জীবন–দক্ষতা অর্জনের শিক্ষাও। দক্ষতার সঙ্গে নৈতিকতা মাধ্যমিক শিক্ষার মর্মবস্তু।

মোট শিক্ষার্থীর বিপুল অংশ—চার ভাগের প্রায় তিন ভাগ—মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শেষে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত হলে জাতি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়। তারা তরুণ, তাই পরিশ্রমী ও কর্মোদ্যমী। এই বিপুল কর্মী বাহিনীই হচ্ছে রাষ্ট্রের আসল শক্তি, বলা যায় সংশপ্তক, রাষ্ট্রের শক্তিশালী দুই বাহু। তাদেরই শ্রমে ও ঘামে সচল থাকে রাষ্ট্রের উৎপাদনব্যবস্থা, যথা: কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, প্রতিরক্ষা, কলকারখানা, পরিবহনব্যবস্থা, অবকাঠামো উন্নয়নের সব কর্মযজ্ঞ।

রাষ্ট্রের বাহু যদি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি, তবে তার হৃৎপিণ্ড হলো বিষয়ভিত্তিক প্রফেশনালরা। শিক্ষার এ স্তরকে বলা হয় আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন পর্ব। এ স্তর উপহার দেয় গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, মৌল ও ফলিত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, আইনজ্ঞ, অর্থশাস্ত্রী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতিক, শিক্ষাবিজ্ঞানী, প্রশাসক, ব্যবস্থাপক, কূটনীতিক ইত্যাদি পেশাজীবী। এ পর্বের শিক্ষা একই সঙ্গে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক। বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে এ পর্বের শিক্ষাদান চলে। মেধাবী ও পরিশ্রমীদেরই আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন পর্বে ভর্তির সুযোগ থাকে, যেখানে হস্ত ও হৃৎপিণ্ডের যুগলবন্দী ঘটে। হাতের কাজে রক্ত সঞ্চালনই গ্র্যাজুয়েটদের কর্মিষ্ঠ করে তোলে।

আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন স্তর হলো কেবল মেধাবী গবেষকদের জন্য নির্দিষ্ট। মোট শিক্ষার্থীর অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার সুযোগ পায়। দুরন্ত যৌবনেই মেধাবীরা এ পর্বে জ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করে; গবেষণায় মগ্ন থাকে সারা জীবন। তারাই রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক, রাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক। বিজ্ঞান গবেষণা, দেশের আগামী চাহিদা নিরূপণ, নীতি-কৌশল নির্ধারণে মূল ভূমিকা তাদের।

বিশ্বব্যাপী অনুসৃত এ নীতিকৌশল বাংলাদেশে সচল নয়। অর্থাৎ, আমরা দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরির জন্য মাধ্যমিক এবং প্রফেশনালস তৈরির জন্য আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন শিক্ষার পরিকল্পনা তৈরি করিনি। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লাখ লাখ তরুণে ভারাক্রান্ত। অথচ মাধ্যমিক সমাপ্তির পর তাদের সিংহভাগেরই এত দিনে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত থাকার কথা।

এখন যদি আমরা এই শিক্ষাস্তরগুলোর সঙ্গে শিক্ষার্থীর বয়ঃক্রম মিলিয়ে দেখি, তাহলে খুব স্পষ্ট হবে যে আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার বয়স মোটামুটি (১১+৫+২+৪) ২২ বছর হতে পারে। আর তা নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যমান ৩০ বছর বয়সে রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদে নিয়োগ পেতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বরং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে নিয়োগের জন্য ২৫ বছর বয়সই আদর্শ হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সে নিশ্চয়তা দেয় না; সে জন্যই চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছর করার দাবি জোরদার হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের এই দাবি ন্যায্য হলে তা দুভাবে পূরণ করা যায়: ১. সেশন জট কমিয়ে যথাসময়ে তাদের শিক্ষাজীবন করে এবং ২. দাবি মেনে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে দেওয়া। কোনটা যুক্তিসংগত এবং করা উচিত?

মানুষ ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সেই সবচেয়ে সাহসী, উদ্যোগী এবং সৃষ্টিশীল থাকে। তারাই সবচেয়ে উদ্যমী। এ বয়সে যারা কর্মে নিয়োজিত হবে, তা রাষ্ট্রীয় বা অরাষ্ট্রীয় যা-ই হোক, জাতি তাদের কাছ থেকে সর্বোত্তম সৃষ্টিশীল সেবা আশা করতে পারে। এটি নিজেদের জন্যও আশীর্বাদস্বরূপ। কেননা, এই বয়সেই তারা ব্যক্তিগত জীবনকে সুন্দর পরিকল্পনায় সাজিয়ে গড়ে তুলতে পারে।

প্রশ্ন হলো মানুষের জীবনের সর্বোত্তম ফলপ্রসূ সময় তারুণ্য ও যৌবনকালে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব কার? এক কথায় উত্তর: রাষ্ট্রের। পরিকল্পনাহীনতা কিংবা সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব হলে তরুণ, যুবকদের যথাসময়ে কাজে নিয়োজিত করা যায় না। আবার শ্রমঘন শিল্পের বিকাশ ছাড়াও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় না।

সরকারি কর্মে প্রবেশের বয়স বাড়ানো, দীর্ঘ মেয়াদে, আত্মঘাতী এক সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি আদর্শকে মান্যতা দেয় না। এখনই তাই গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সেভাবে প্রণয়ন করতে হবে গোটা কারিকুলাম। কারিকুলাম এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যেন, সে শিক্ষা আধুনিক, প্রাযুক্তিক দক্ষতাভিত্তিক হয়; একই সঙ্গে তা যেন অবশ্যই নৈতিকতা ও মানবিকতাবাদী হয়। আমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে যথাসময়ে শিক্ষাজীবন শেষ নিশ্চিত করা এবং ৩০ বছর হওয়ার আগে কর্মজীবনে প্রবেশের নিশ্চয়তা বিধান করা। বলা বাহুল্য, দুটি দায়িত্বই সরকারের।

লেখক: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading