মোঃ আঃ বাতেন ফারুকী।।
বাংলাদেশে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী, সমাজ, পেশাজীবি ও রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন, সংগ্রাম করে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও আধুনিক কল্যাণকর রাষ্ট্রে আন্দোলন ও সংগ্রাম না থাকলে কিংবা এগুলোর স্পেস না থাকলে উল্লেখিত ব্যবস্থাসমূহ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হতে পারে। গণতান্ত্রিক আচার আচরণ এদেশের মানুষের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
প্রগৈতিহাসিক আমল থেকেই এ ভূখণ্ডের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জিইয়ে রাখার জন্য আন্দোলন -সংগ্রাম করে আসছে। শত নিপীড়ন -নির্যাতন আন্দোলন -সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি, এখনও পারবে না। দমন-পীড়ন চালিয়ে কিংবা চোখ রাঙিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামকে থামিয়ে দেয়া যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। দেশ জন্মের পর থেকে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। কোনো আন্দোলনকেই দমন করা যায়নি। যার বাস্তব প্রমাণ আমরা পেয়েছি। হয়তোবা সাময়িকভাবে সুপ্ত রাখা যায়, নির্মূল করা যায় না।
আজকে শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে কিছু লেখার প্রয়াস রাখছি। এদেশে শিক্ষক আন্দোলন নূতন কিছু নয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এ অঞ্চলে বৃটিশরাই মূলত শিক্ষার আসল প্রচলন ঘটানোর পথিকৃৎ। তাদের হাত ধরেই বাংলা বা ইংরেজি শিক্ষা যা-ই বলি না কেন -এর বিস্তার শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই এক শ্রেণির ধনিক সম্প্রদায়, অভিজাত শ্রেণির মানুষ, দানবীর,শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ স্ব উদ্যোগে কিংবা অনুপ্রাণিত হয়ে অথবা নিজের নামকে স্মরণীয় করে রাখার মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগানোর নিমিত্ত নিজেদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।
তাছাড়া সামাজিকভাবে সমাজের বিশিষ্টজনেরা দলবদ্ধ হয়ে দলগত প্রচেষ্টায় কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। এগুলোর পরিক্রমা অদ্যাবধি চলছে। পরবর্তীতে অনেক পরে সরকার অবহেলিত ও নিগৃহীত শিক্ষক সমাজকে জাতীয় স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারি অনুদান প্রদান করতে শুরু করেন। তাও অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পরে। ধাপে ধাপে আন্দোলন হয়েছে, প্রতিবারই সরকার আন্দোলনকে বলপূর্বক দমন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সরকার কি সফল হয়েছে?
এরপরও কেন জানি সরকার বারবার একই কাজ করে যাচ্ছে।
ঐতো বিগত ২৮ জুলাই, ২০১৯ তারিখে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারি অবসর সুবিধা বোর্ড ঘেরাও কর্মসূচী পালন করতে দেয়া হয়নি। ঐদিন জাতি কী অবলোকন করল? অবশ্য শিক্ষক আন্দোলনের খবর জাতীয় দৈনিকগুলোর কখনও শিরোনাম হতে পারেনি। জাতি গড়ার কারিগর খ্যাত নিরীহ শিক্ষক সমাজ একটি শান্তিপূর্ণ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পেশাগত আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচী পালন করতে চেয়েছিল কিন্তু পুলিশি বাধার কারণে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী নিমিষেই পন্ড হয়ে যায়।
এতে কি সরকার লাভবান হয়েছে? মোটেই না। কারণ শিক্ষক আন্দোলনের কর্মসূচীর দাবিনামা রচিত হয় তাদের মৌলিক চাহিদা অনুযায়ী। এখানে কোনো ধরনের বিলাসিতা বা আধিক্যের স্থান হয় না। তাদের পরিবারের দৈনন্দিন খরচটুকু নির্বাহ করার নিমিত্ত যেটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হন। আর তাই একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষকগণও স্বপ্রণোদিত হয়ে কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। শুধু এই আশায়- যদি সরকারের শীর্ষ মহল তাদের কথা শুনেন।
শিক্ষকতা পেশায় ঢুকেছি সেই সাতাইশ বছর আগে। অভিজ্ঞতা একেবারে কম হয়নি। ভেতর থেকে নিজেদের সম্পর্কে যা জেনেছি, যা দেখেছি বা যা উপলব্ধি করেছি তার সবটুকু সুখকর নয়। এমনিতেই আমরা নিজেদের দোষ দেখতে বা নিজেদের সমালোচনা শুনতে বা করতে কোনোটাতেই অভ্যস্ত নই। তবুও আমার সহকর্মীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেই আত্মসমালোচনা করছি। কারণ আত্মসমালোচনাতেই আত্মশুদ্ধি সম্ভবপর।
সত্যি কথা বলতে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা থাকার দরুন অতীতে অনেক নিয়োগ(সবক্ষেত্রে নয়)সঠিক হয় নাই। যার দরুন শিক্ষকতা পেশায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ ঘটেছে। একথা মানতেই হবে শিক্ষকদের জানতে হবে সবার চেয়ে বেশি। তাদেরকে জ্ঞানের দিক থেকে আপ-টু-ডেট থাকতে হবে।
যাই হোক অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা এখন আর খুব বেশি নেই। আমরা এখনও যারা রয়ে গেছি তারাও কয়েক বছরের মধ্যেই চলে যাবো ইনশাআল্লাহ। তবুও সরকারের প্রতি সবিশেষ ও সবিনয় অনুরোধ শিক্ষক সমাজের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের পাল্স বা স্পন্দন বুঝার চেষ্টা করুন। জাতির স্বার্থে,একটি উন্নত ও টেকসই প্রজন্ম গড়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি। আর শিক্ষকদের অভাব-অনটনে রেখে প্রকৃত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা আদৌ সম্ভবপর নয়। এমনিতেই বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার উন্নয়নই সবচেয়ে টেকসই উন্নয়ন। তাই সরকার ঘোষিত এসডিজি অর্জনের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে সকলে মিলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা দরকার। একবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা ও শিক্ষকের মানোন্নয়নে আন্দোলন-সংগ্রাম করা জাতির জন্য লজ্জাকর বটে। কাজেই আর বিলম্ব না করে জাতি গড়ার কারিগরদের সামর্থের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও মনোনিবেশ করা সরকারের আশু করনীয় হওয়া উচিত।
সন্তানেরা যদি পিতা-মাতার কাছে ভালো খাবার কিংবা ভালো শিক্ষার দাবি করে তাদেরকে ধমক দিয়ে বা বলপূর্বক দমন করার অধিকার পিতামাতার থাকা উচিত না। সব পিতামাতার আর্থিক সক্ষমতা অথবা দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শন এক রকম হয় না। পিতা বা মাতা হিসেবে আমরা সন্তানদের দাবি উপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের সামর্থ না থাকলেও স্বীকার করা উচিত – তাদের চাওয়া সঠিক। কারণ যেখানে পিতামাতা নিজে থেকেই সন্তানদের ভালো খাবার, ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।
পাদটীকা : এক পল্লী চিকিৎসক বাবা সাংসারিক প্রয়োজনে নিজের এলাকা ছেড়ে অনেক দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুব কষ্টের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে তার সন্তানদের পড়াশোনা করিয়েছেন। ফলস্বরূপ একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রতিটি সন্তানই মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে, অন্য এক বাবা নিজের সামাজিক স্ট্যাটাস(!) বজায় রাখার জন্য নিজে অন্যের জমিতে কাজ না করে সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে তাদের দিয়ে অন্যের জমিতে শিশু শ্রম করিয়েছেন এবং এভাবেই সংসার চালিয়েছেন। পরবর্তীতে শিল্পায়নের ফলে সন্তানেরা শহরমুখী হয়ে বিভিন্ন অদক্ষ পেশায় (বৈধ) জড়িয়ে নিজেদের অবস্থান মোটামুটি শক্ত করেছেন এবং তারাও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত।
লেখক-
প্রধান শিক্ষক
সৈয়দ হাবিবুল হক উচ্চ বিদ্যালয়
বৌলাই, কিশোরগঞ্জ।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
শিক্ষাবার্তা ডট কম অনলাইন নিউজ পোর্টাল
