আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় একান্নবর্তী পরিবারের যে প্রথা সমাজে প্রচলিত ছিল, তা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। এর ফলে আগে শিশুদের মধ্যে যে সামাজিক রীতিনীতি (যেমন, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, অল্প একটু খাবার একাধিক ভাইবোনের মধ্যে ভাগাভাগি করে খাওয়া ইত্যাদি) ছিল, তা অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের বাস্তবতায় ক্রমাগত একান্নবর্তী/যৌথ পরিবার প্রথা বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে একক পরিবারপ্রথা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে শিশুদের সুযোগই নেই এমন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার। আগে একজনের উপার্জনের টাকায় সংসারের খরচ চলত। কিন্তু বর্তমানে পরিবারে একাধিক সদস্য ও নারীদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কারণে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হতে হয়েছে, যা একক পরিবার প্রথাকে ত্বরান্বিত করেছে। এমন অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে শিশুদের মধ্যে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ-এইসব গুণের সংমিশ্রণ ঘটানোর উত্তম জায়গা হলো প্রাথমিক স্কুল।
আবার মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো লো- স্কিলড জনগোষ্ঠী তৈরি করা এবং যাদের আগ্রহ ও যোগ্যতা আছে, তাদের পরবর্তী শিক্ষাস্তরের (উচ্চশিক্ষা) জন্য প্রস্তুত করা। লো-স্কিলড জনগোষ্ঠী সমাজের মিড লেভেলে কাজ করে, যেমন-পানির মিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কাঠমিস্ত্রি ইত্যাদি। এই জনগোষ্ঠীও সমাজের জন্য অপরিহার্য। একটি দেশে একজন সরকারি কর্মকর্তা বা একজন শিক্ষক যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই একজন ইলেকট্রিশিয়ান বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রয়োজন। যেটা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করা এবং গবেষণার মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার কনটেন্ট তৈরি করা, যা সময়োপযোগী। উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করার জন্য দরকার গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে আমাদের দেশের কোন খাতে কী পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, সেটি অনুমান করবে এবং পাশাপাশি বিশ্বায়ন ও ডিজিটালাইজেশনের কথা মাথায় রেখে কী ধরনের দক্ষতা
প্রয়োজন, সেটিও জানা যাবে। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের কাররিকুলাম সংস্কার করে যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করবে, যেন বেকারত্বের কালো থাবা থেকে দেশ মুক্তি পায়।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাধ্যমিক শিক্ষা সফল হবে, যদি প্রাথমিক স্কুল ভালো ছাত্র তৈরি করতে পারে। আবার উচ্চশিক্ষার সফলতা নির্ভর করবে মাধ্যমিক স্কুল ভালো গ্র্যাজুয়েট সরবরাহ করতে পারছে কি না, তার ওপর। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সফল তখন হবে যখন সেগুলো উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো ছাত্র তৈরি করতে পারবে। সেই দক্ষ মানবশক্তি আবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষক হিসেবে অবদান রাখবে। আশার কথা হলো বাংলাদেশের অনেক কৃতী সন্তান বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার মাধ্যমে কৃতিত্বের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান, সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এমতাবস্থায় তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে দেশে এনে এবং এই প্রতিকূল পরিবেশেও যারা দেশে থেকে ভালো গবেষণা করছেন, তাদের সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থার যুগোপযোগী পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গঠনের একটি প্রয়াস হতে পারে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া, এবং সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/৩০/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.