এইমাত্র পাওয়া

নতুন শিক্ষাক্রমের গন্তব্য অজানা

ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিনঃ শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের প্রকৃত মানবিক মানুষ তৈরির শিক্ষাক্রম চালু হোক। তাদের মূল্যবোধ জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে জাতিকে সামনে নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাক্রমের এ পরিবর্তন আগামী দিনের কাণ্ডারিদের মেধাবী মানুষরূপে এগিয়ে নিতে পারবে-

আমাদের শিক্ষার পরিবর্তন বহুবার হয়েছে বহুভাবে। চলতি বছর নতুন শিক্ষাক্রম চারটি শ্রেণিতে পরীক্ষামূলক শুরু করেছে সরকার। এরই মধ্যে এ শ্রেণিগুলোর পড়ালেখা, পরীক্ষা ও অপরাপর বিষয় নিয়ে নানামুখী কথাবার্তা শুরু হয়েছে। বিষয়গুলোর উপযুক্ত শিক্ষক গড়ে না তোলা ও পরীক্ষাহীন পড়ালেখা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার কাটাছেঁড়া বহুকাল থেকে চলে আসছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ শিক্ষার এখনো কোনো পর্যায়ে পৌঁছেনি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার নতুন পরিবর্তন আসছে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়েই শুরু করি—

‘বঙ্কিম চন্দ্র ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু অবাক করা বিষয়, তিনি বিএ ফেল করেছিলেন। দুর্ভাগ্য তিনি ফেল করেছিলেন বাংলায়। তাকে গ্রেস দিয়ে পাস করানো হয়েছিল। অথচ তার বাংলা পড়ে আমরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করি। আমরা উঠতে-বসতে তার বাংলায় ফেল করি।’ তাহলে প্রশ্ন পরীক্ষায় এক্সামিনার কে ছিলেন? এক্সামিনার ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মজার ব্যাপার হলো, বঙ্কিম ছিলেন ফেলের মধ্যে আবার ফাস্ট। এভাবে বাঙালি গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে তিনি প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়ার গৌরব লাভ করেন।’

বঙ্কিম চন্দ্রের মতো একজন প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ কেন এমন ফলাফল করলেন? বাংলা ছিল তখন দারুণ সংস্কৃতঘেঁষা। সেই সংস্কৃতের কঠিন ও দুরূহ বিষয়গুলো তার পক্ষে মুখস্থ করা ছিল কঠিন। এখানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও আলোকিত মানুষ চাই আন্দোলনের পুরোধা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার লিখেছেন এভাবে, ‘যে বাংলা পরীক্ষায় বঙ্কিমচন্দ্র ফেল করেছিলেন, সেই পরীক্ষার প্রশ্ন বের হয়েছিল কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। আমিও সেই প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আদাজল খেয়ে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কিছুতেই ১০০-এর মধ্যে ১৬ নম্বরের বেশি উত্তর করতে পারিনি।’

শুনছি নতুনভাবে যে শিক্ষাক্রম আসছে, তা হবে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক। নতুন শ্রেণিগুলোতে তাই হচ্ছে। এর মাধ্যমে ১০ ধরনের দক্ষতা শেখানোর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে। ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জীবন-জীবিকা বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। একজন শিক্ষার্থীকে যেভাবে গড়ে তোলা দরকার, এর সবকটি ধারণাই এখানে সংযুক্ত থাকবে। আদৌ? হয়তো। তবে এ জাতীয় ব্যবস্থার ফলে আশা করা যায় একটি পরিবর্তন আসবেই। মুখস্থবিদ্যা শুধু একটি মুখস্থ জাতি উপহার দিয়েছে তা নয়, বরং কালের পর কাল জাতিকে পিছিয়ে দিচ্ছেও। সত্যিকার অর্থে এর বেশি আর কিছু দিতে পারেনি। সময়ের প্রয়োজনে তাই এ বিদ্যার অবসান দরকার। একটি সৃজনশীল জাতি পাওয়ার জন্য, সৃজনশীল পৃথিবী সৃষ্টির জন্য দরকার মেধা, মননে উদীয়মান একঝাঁক শিক্ষার্থী, যাদের দ্বারা এ পৃথিবী আলোর মুখ দেখবে। আমাদের এ মুখস্থবিদ্যায় যে জাতি পাচ্ছি, তাদের কপাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বললেন—

‘যে ছাত্র পকেটে করে নকল নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢোকে তাকে তোমরা হল থেকে খেদিয়ে দাও আর যে মগজের ভেতর চুরি করে নিয়ে ঢোকে তাকে তোমরা শ্রেষ্ঠ ছাত্রের সম্মান দাও, এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা।’

রবীন্দ্রনাথের এ দুঃখমাখা বক্তব্য আমাদের যত হতাশার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, আমাদের জীবনের বোধকে আমরা শিখতে পারি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পারিবারিক ব্যবস্থায় শিশুকে তার মতো চলার পথ শেখানো হয় না। তবে আমার লেখার বিষয়টি নিয়ে এখনো গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে, এর কোনো আলো এখনো মুখ দেখেনি। কবে দেখবে, আদৌ দেখবে কি না, তা সময় বলবে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন এ শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি বিষয়ের ওপর দক্ষতা অর্জনের বিষয়ে শেখানো হবে। বিষয়গুলো—১. সূক্ষ্ম চিন্তা; ২. সৃজনশীল চিন্তা; ৩. সমস্যার সমাধান; ৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণ; ৫. সহযোগিতা; ৬. যোগাযোগ; ৭. বিশ্ব নাগরিকত্ব; ৮. স্ব-ব্যবস্থাপনা; ৯. জীবিকায়ন; ১০. মৌলিক দক্ষতা। এখানে মানবিক মূল্যবোধ বা নৈতিক জ্ঞান। পারিবারিক শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সামাজিক ন্যায়বিচার বা মূল্যবোধ শিক্ষার অনুপস্থিতি রয়েছে। এ বিষয়গুলো সংযোজন বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রয়োজনীয় বলে আমি মনে করছি। মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বহীন শিক্ষা সবসময় মূল্যহীন এটি বোঝানোর আর সুযোগ নেই। এ ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞান ও রাজনৈতিক সৃষ্টাচার সম্পর্কেও পাঠ্যবইতে থাকা জরুরি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষার যে পরিকল্পনা বা চিন্তা, এটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। একমুখী শিক্ষা বলতে বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা নামে যে গ্রুপ রয়েছে, তা থাকবে না। আমাদের শিক্ষার আজ যে দুরবস্থা চলছে, তা উত্তরণ সময়ের দাবি। এখানে খরা ধরেছে, সব শেষ হওয়ার আগেই প্রতিষেধক দেওয়া দরকার। প্রত্যেক শিশুর ছোটবেলায় নানা স্বপ্ন থাকে, শখ থাকে, জীবনে অনেক বড় হওয়ার ইচ্ছা থাকে অনেকদূর যাওয়ার। সেই ইচ্ছার বাস্তবায়নে কার্যকর শিক্ষা সংস্কার জরুরি। গতানুগতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বাদ দিতে হবে, তাহলে শুধু এ অবস্থা থেকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই রকম নতুন কিছু না থাকার কারণে ছোটবেলার শিশুর সেই স্বপ্নগুলো বিবর্ণ হয়ে যায়। শুধু পড়ালেখা একজন শিশুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অধিকতর সবকিছু নয়। একের পর এক ক্লাস, বই, শিক্ষক পরিবর্তনের মাধ্যমে দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের যে অবস্থা চলতে থাকে, একজন শিশুর প্রকৃত বৃদ্ধিতে তা যথেষ্ট বাধা দেয়। আমাদের স্কুল-কলেজ বা উচ্চতর শিক্ষা একজন শিশুকে শুধু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার তাগাদা দেয় কিন্তু এ কথা ভুলে যায় যে, দৈহিকভাবে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসিক বৃদ্ধিও কাজ করে। এই দেশ কি তাহলে শুধু মানুষকে ডাক্তার বানাতে শেখাবে? কেন, আরও অনেক পেশা তো আছে, সেসব পেশায় যাবে না কেন? শিক্ষার্থীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক বা প্রচলিত পদ্ধতিতে আমাদের তেমন কোনো অবস্থা নেই। শিশু হতে পারে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ভালো বক্তা, শিক্ষক, উদ্যোক্তা, আইনজীবী বা রাজনৈতিক। যে যেভাবে বেড়ে উঠতে চায় তাকে সেভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে, তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রে শূন্যতার হাত থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারব। একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, ‘তুমি যদি কাউকে এক কেজি মাছ দাও তাহলে তার এক দিনের আহারের ব্যবস্থা করলে আর যদি কাউকে মাছ ধরতে শিখিয়ে দাও, তাহলে তুমি তার সারা জীবনের খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে।’ শ্রেণিকক্ষে আজ পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কিছু শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের ওপর রয়েছে বাধ্যবাধকতা। আমরা চাইলেও পারি না নতুন কিছু শিক্ষা দিতে। কারণ পাঠ্যবইয়ের এ-সংক্রান্ত কিছুই নেই। একদিকে শিক্ষার্থীরা নিতে চাইবে না, অন্যদিকে অভিভাবক দারুণ খেপে যাবে, পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। কিন্তু আগামী প্রজন্মকে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল করার জন্য আধুনিক শিক্ষার প্রতি, আনন্দময় শিক্ষার প্রতি আমাদের অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিতে হবে, অন্যথায় কোনোক্রমেই বিশ্বের সঙ্গে আমরা তাল মেলাতে পারব না। সুতরাং শিশুকে সৃজনশীল করার জন্য আমাদের পাঠ্যক্রম সৃজনশীল করা উচিত। যারা শিশুদের নিয়ে ভাববেন তাদের সৃজনশীল হওয়া আগে চাই, তাহলে প্রকৃতপক্ষে আমরা একটি সুন্দর প্রজন্ম পাব। অন্যথায় দোষারোপের এ সমাজ পশ্চাদমুখী আত্মকেন্দ্রিক ও পরনির্ভরশীল একটি জাতি তৈরির ক্ষেত্রটাকে দিনের পর দিন বেগবান করবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের প্রকৃত মানবিক মানুষ তৈরির শিক্ষাক্রম চালু হোক। তাদের মূল্যবোধ জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে জাতিকে সামনে নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাক্রমের এ পরিবর্তন আগামী দিনের কাণ্ডারিদের মেধাবী মানুষরূপে এগিয়ে নিতে পারবে। তাই আবারও অতীতের মতো অনুরোধ করব, অনেক হয়েছে, এবার আসুন মেধাবী ও মানবিক মানুষের জন্য আমরা চিন্তা করি।

লেখকঃ  শিক্ষাবিদ-নজরুল গবেষক

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৫/১১/২০২৩  

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.