বিমল সরকার
ক্ষেত্রবিশেষে নথি ও তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-পর্যালোচনা সবকিছুই ঠিক আছে; কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি-উন্নতি ও সাফল্যের এ যুগে এক মাসের কাজে ছয় মাস, ছয় মাসের কাজে চব্বিশ মাস কিংবা এক বছরের কাজে চার বছর সময় লাগিয়ে দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে সবার মনে বিস্ময়ের উদ্রেক হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
অথচ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমনই হয়, হয়ে আসছে আমাদের দেশে। আর বাস্তবে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহ ও নির্দেশে সরকার যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি কলেজ এবং সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই সেসব উপজেলায় একটি করে কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করার কাজ এগিয়ে চলেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকাল, অবকাঠামো, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংখ্যানুপাত এবং বিগত বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল এসবকিছুর ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেই চূড়ান্ত অনুমোদনটি দেয়া হয়। সরকারিকরণের লক্ষ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দফায় দফায় তালিকাভুক্ত অন্তত ৩০০ কলেজ এবং ৩৫০টি বিদ্যালয়ের পরিদর্শন কাজ সম্পন্ন হয়।
এরপর বছরজুড়ে চলে ‘ডিড অব গিফট’ বা দানপত্র সম্পাদনের কাজ। ২০১৮ সালে হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই সরকারি আদেশ (জিও) জারি। যে কোনো স্তরেরই হোক- বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানে শত রকমের আর্থিক দৈন্যদশা, দান-অনুদান, অভাব-অভিযোগ, বৈষম্য, অনিশ্চয়তা ও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা।
মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা স্তরে একসঙ্গে এত অধিকসংখ্যক প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করা আমাদের দেশে এই প্রথম। এমন একটি মহতী উদ্যোগ ও কার্যক্রমে কেবল বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারী নয়, বলা যায় একেকটি এলাকায় সর্বস্তরের জনগণের মাঝেই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়।
প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের খবরে আনন্দ-উল্লাস ও উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মচারী অনেকের মনেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-দুর্ভাবনাও দেখা দেয়। এমনটা হওয়ার মূল কারণ সংশ্লিষ্টদের কাজকর্মে অদক্ষতা, মন্থরতা ও দীর্ঘসূত্রতা।
এমনও নজির রয়েছে, কলেজ সরকারিকরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে ২০১৩ সালে, সরকার ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পদ-সম্পত্তির দানপত্র সম্পাদন এবং সে আলোকে সরকারি আদেশও (জিও) জারি হয়েছে; অথচ দু’বছরেও শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন না হওয়ায় তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
ফলে তারা বেতন হিসেবে এমপিওর টাকাটা উত্তোলন করতে সক্ষম হলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত অংশের টাকাটাও দীর্ঘদিন ধরে উত্তোলন করতে পারছেন না। এরূপ দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে তাদের মাঝে বিরাজ করছে এক ধরনের হতাশা ও দুর্ভাবনা।
নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৯। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারি সুবিধাদিসহ ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরি করতে পারেন। এটা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়, সরকারিকরণের ঘোষণা দেয়ার সময় যার বয়স ৫৬ বা ৫৭, আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে করতেই তার বয়স ৫৯, এমনকি ৬০ পেরিয়ে যাবে এবং এ কারণে তিনি সরকারিকরণের আওতাভুক্ত হবেন না!
দু-দশজন বা এক-দু’শজন নয়, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে দু-চারজন করে দেশব্যাপী সংখ্যাটি আনুমানিক তিন হাজার হয়ে যাবে, যাদের দু-তিন বছর ধরে সরকারি হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেসরকারি থেকেই একে একে অবসরে চলে যেতে হয়েছে।
অথচ এমন শিক্ষকরা অন্য সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১৬ সাল অর্থাৎ একেবারে শুরু থেকেই সরকারিকরণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত-সক্রিয় ছিলেন। আহা, উৎসাহ আর উদ্দীপনার পাশাপাশি একেকজন শিক্ষকের সে কী বিড়ম্বনা-দুর্ভোগ-ভোগান্তি-মনোযন্ত্রণা!
পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগপত্র-পদোন্নতিপত্র-নিয়োগ বোর্ড গঠনের তথ্য-উপাত্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বোর্ডে বোর্ডে ঘুরে রীতিমতো হেনস্তা হয়ে মূল সনদপত্র জোগাড়, ‘ডিড অব গিফট’ বা পরিদর্শন কাজ সম্পাদনের পরও দফায় দফায় অন্তত চার-পাঁচবার এসব নথিপত্র প্রদর্শনসহ অনেক ধাপ-প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হওয়া- এক প্রকার অগ্নিপরীক্ষারই শামিল।
এসবকিছু করেও শেষ পর্যন্ত বাদ পড়ে যাওয়াকে একমাত্র ‘ললাটলিপি’ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? শুধু কি তাই? বর্তমানে অনেকেরই ৫৭, ৫৮ কিংবা ৫৯ বছর চলছে।
যদিও সরকারি আদেশ (জিও) জারির সময় বলা হয়, ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট যাদের বয়স অনধিক ৫৯ শুধু তারাই সরকারিকরণের আওতাভুক্ত হয়ে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন। কিন্তু স্বপ্নের জাল নিয়ে অপেক্ষমাণ অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তিরা নিকট-পূর্বসূরিদের পরিণাম-পরিণতির কথা ভেবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না।
সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়োগ নিষেধাজ্ঞাসহ অর্থ ব্যয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। অনেক কলেজে নিয়মিত অধ্যক্ষ নেই। উপাধ্যক্ষ পদও শূন্য। আবার একই সঙ্গে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ দুটি পদই শূন্য।
ভারপ্রাপ্ত দিয়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব কারণে শিক্ষাদান ও দাফতরিক কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আবার না সরকারি, না বেসরকারি অবস্থানে থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বাভাবিক মনোবলও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
সরকারিকরণের প্রক্রিয়াধীন বহু প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাকি-বকেয়ার পরিমাণটি হাজার হাজার নয়, ব্যক্তিগতভাবে একেকজন শিক্ষকেরই কয়েক লাখ টাকা করে হয়ে যাবে।
শত রকমের দৈন্যদশার মাঝ দিয়ে দিনাতিপাত করলেও ভুক্তভোগীদের মনে সুদৃঢ় আশা, একদিন না একদিন তারা যার যার প্রাপ্য বকেয়া টাকা পেয়ে যাবেন; কিন্তু বাস্তবে গুড়েবালি। শুধুই কি তা? বকেয়া পড়ে রয়েছে আট-দশ, এমনকি পনেরো-বিশ বছর আগে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদেরও বেতন-ভাতা হিসেবে লাখ লাখ টাকা। এসব বকেয়াদি পাওয়া এবং না-পাওয়া নিয়েও কর্মরত এবং অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের ভাবনা-দুর্ভাবনা এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই।
বর্তমান জমানায় কোনো ক্ষেত্রে এমন দীর্ঘসূত্রতা কাম্য নয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দ-বন্ধটি কেবল দেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনার বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে উপজেলায় উপজেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের উদ্যোগটি হাতে নিয়েছেন। গত তিন-সাড়ে তিন বছরে ধাপে ধাপে আনুষঙ্গিক যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও মূলত শিক্ষক-কর্মচারীদের পদসৃজন না হওয়ার কারণে তা এখনও বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।
যে কোনো উপায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার মনে জাগ্রত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উৎসাহ-উদ্দীপনাটিকে ধরে রাখা দরকার। খেয়াল রাখতে হবে, এ নিয়ে বিরাজমান ভাবনা-দুর্ভাবনা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিধিটি যাতে কোনোক্রমেই আর বিস্তৃত না হয়।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.