এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষা ব্যবস্থার এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা দূর করতে হবে

অলোক আচার্য: দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেন সবচেয়ে রুগ্ন দশায় রয়েছে। ঠিকঠাক এগুতেই পারছে না। সামনে যেতে চাইলেই যেন হোঁচট খাচ্ছে। শিক্ষা এমন একটি খাত যে খাত থেকে সরাসরি অর্থ আসে না তবে দেশকে এগিয়ে নিতে, বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার ওপর চেপে বসেছে কোনো গভীর অন্ধকার। যে শিক্ষা একটি দেশের সবচেয়ে অগ্রাধিকার, একটি দেশের উন্নয়নের কেন্দ্র্রবিন্দু, উন্্নয়নের প্রধান মাপকাঠি এবং একটি প্রজন্মকে প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তোলার প্রধান হাতিয়ার সেই শিক্ষাই এখন কেমন যেন ভজঘট অবস্থায় রয়েছে। শিক্ষার এই অবস্থা শুরু হয়েছে মূলত করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হলে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে প্রাকৃতিক কারণ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিক্ষা বারবার থমকে যাচ্ছে। কখনো অতিরিক্ত শীত, অতিরিক্ত গরম বা এ ধরনের কোনো কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকছে। শিক্ষা বিষয়টি এমন যে ছাত্রছাত্রীরা যদি পড়ালেখার মধ্যে না থাকে তাহলে আগের পাঠগুলো নতুন করে সামনে আনতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে একটু কঠিন পরিস্থিতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের থাকতে হয়। নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। বিষয়টা আসলে জটিল। কারণ অনেক পাবলিক পরীক্ষাও সঠিক সময়ে এবং পূর্ণ সিলেবাসে নেওয়া যায়নি। এর ফলে কিন্তু এই জেনারেশনে একটি গ্যাপ ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। যদি কেউ বলে যে তারা কম শিখেছে তা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। কম পড়া মানে কম জানা। যদিও এর বিকল্পও ছিল না। স্কুল কলেজে সিলেবাস শেষ হয়নি। এরপর আবার গত বছর থেকে চালু হয়েছে নতুন কারিকুলামে শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োগ। চিরাচরিত পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে একটি নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করাই এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য।

এই কারিকুলামে মূলত পড়ালেখা হবে আনন্দের। এর সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞরা এমনটাই বলেন। পরীক্ষা ভীতি থেকে ছাত্রছাত্রীদের বের করে আনা এবং চিরায়ত পাস-ফেল মার্কা পদ্ধতির বিলোপ ঘটানোই এর উদ্দেশ্য। অর্থাৎ একটি ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এই কারিকুলামের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের একটি বড় অংশ এবং শিক্ষকরাও নতুন এ কারিকুলামে অনেক সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন। কারিকুলাম নতুন হতেই পারে। তবে তার গ্রহণযোগ্যতা সব মহলে থাকতে হবে বা করাতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। তবে আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে মনে হয় একটু বেশিই। অন্য কোনো দেশে এত ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি চালু নেই অথবা এত ঘন ঘন পরিবর্তনও আসে না। এই যে ঘন ঘন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এর শিকার হয় ছাত্রছাত্রীরা। কখনো গ্রেড থাকছে, কখনো গ্রেড বাতিল হচ্ছে, কখনো পরীক্ষা থাকছে, আবার থাকছে না এসব পরিবর্তনে প্রভাব পরছে ছাত্রছাত্রীদের উপর। একটা বাতিল করা হয়েছে আবার নতুন কিছু গ্রহণ। আবার দেখা গেছে কয়েক বছর পর পুরাতন বিষয়টিকেই গ্রহণ করা হয়েছে। এই যে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। কত বছর পর এই নতুন কারিকুলামে এর উপসংহার ঘটেছে। এখন আবার বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উঠেছে এই কারিকুলাম বাতিলের। এই কারিকুলাম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব দ্রুত। অন্যথায় পুরোপুরি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিেেত হবে। অথচ ঘষামাজা করতে করতেই এ বছর পেরিয়ে গেছে অর্ধেক সময়। গত বছর তো বুঝতে বুঝতেই পার হয়েছে। শিক্ষকরাও আজও বুঝে উঠতে পারেননি। তারপর ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো। এরপর মূলত কী হবে তা কারও জানা নয়। এইচএসসি পরীক্ষা থমকে আছে। এটি থমকে থাকা মানে পরবর্তী উচ্চ শিক্ষা থমকে থাকা। ছাত্রছাত্রীর মাথায় টেনশন। পরীক্ষার্থীরা আছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। ঠিক কবে পরীক্ষা শেষ হবে তা কারোর জানা নেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে হবে। এবং অবশ্যই কারিকুলাম নিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এর মধ্যেই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। যখনই কোনো দুর্যোগ তা প্রাকৃতিক হোক বা মানবসৃষ্ট হোক তখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর কারণ মূলত ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তাই সবার আগে। শিক্ষা খাতের ক্ষতি আর্থিক মাপকাঠিতে পরিমাপ করা যায় না। এর মাপকাঠি ভিন্ন। নতুন কারিকুলাম চালুর পর থেকেই যে পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে সেখান থেকে এখনও বের হতে পারিনি। শিক্ষা খাত পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ খাত যার ক্ষতি থেকে উত্তরণ খুব কঠিন। একটি জানার বা জ্ঞানগত গ্যাপ বা শূণ্যস্থান যা শিক্ষার্থীদের জীবনে ইতিমধ্যেই ঘটে যাচ্ছে তা পূরণ করতে কত বছর সময় প্রয়োজন বা আদৌ তা পূরণ সম্ভব কি না তা নিয়েই সন্দিহান। যদি এই নতুন কারিকুলামের আবারও কোনো রদবদল হয় অথবা পরীক্ষা পদ্ধতি আগের মতো ফিরে আসে সেক্ষেত্রে এই ছাত্রছাত্রীগুলো আবারও একটি সমস্যার মুখোমুখি হবে। তাছাড়া নতুন কারিকুলামে ইতিমধ্যেই প্রশিক্ষণ ও বই তৈরির ক্ষেত্রে বহুদূর অগ্রগতি হয়েছে। বই নিয়ে সমালোচনা আসলে কম থাকলেও মূল সমালোচনা পরীক্ষা পদ্ধতি এবং পাবলিক পরীক্ষার ধরনে। কিছু সমালোচিত অধ্যায় এবং শব্দ বাদ দিলে বইগুলো বেশ চমৎকার। প্রয়োজনে আরও সংযোজন এবং সংশোধন করা যেতে পারে। সময়ের সাথে সাথে নতুন তথ্য এবং তত্ত্ব দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের পরিবর্তনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাদের গ্লোলাব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সুতরাং কিছু পরিবর্তন তো অবশ্যই দরকার। তা সে বইয়ে হোক আর পরীক্ষা পদ্ধতিতে হোক।

দেশে এখন পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই ঢেলে সাজানো হয়েছে। অভিভাবকরা কিছুটা পরিবর্তন চাইছেন। তাদের কথা মাথায় রেখেই মান বন্টণে পরিবর্তনের কথাও শোনা গেছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা এই পরিবর্তন কতটা ইতিবাচকভাবে দেখছে সেটাই প্রশ্ন। কারণ আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতি। নানা কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সিলেবাসটাও ঠিকমতো শেষ করা যাচ্ছে না। এই অবস্থা গত কয়েক বছরের। এর ফলে শিক্ষা অর্জনে যে গ্যাপ তৈরি হয়েছে তা কিন্তু পূরণ এখনই সম্ভব হবে না। কারণ এখন চাইলেই পিছনে ফিরে আবার সেসব পড়ে আসা যায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে বাড়িতে পড়ালেখা যে হবেই এ কথা বলা যায় না। কারণ স্কুল একটি সন্তানের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুর মনোজগত তৈরি হয়। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা অনেকদিন সেই সুযোগ সঠিকভবে পাচ্ছে না। তাঁদের সেই সুযোগ দিতে হবে। নিয়মিত ক্লাস চলবে। কারিকুলামের এই দ্বৈরথ দূর হবে। মোট কথা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনরায় স্বাভাবিক গতিতে চলবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, পাবনা।

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১১/০৮/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.