নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুরঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে অতি গোপনে চার পদে নিয়োগ দেওয়ার পাঁয়তারার অভিযোগ পাওয়া গেছে দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ৩নং ফতেজংপুর ইউনিয়নের ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও তার ছেলে দাতা সদস্যের বিরুদ্ধে। গোপনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চার পদের বিপরীতে অর্ধ লক্ষ টাকা লেনদনের অভিযোগও পাওয়া গেছে। আর্থিক লেনদেনের একটি অডিও রেকর্ড শিক্ষাবার্তা’র হাতে এসেছে।
শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এনটিআরসিএ বহির্ভুত চারটি পদে (নিরাপত্তাকর্মী, নৈশ্য প্রহরী, আয়া ওপরিচ্ছন্নতা কর্মী) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হরমুজ আলী শাহ এবং তারই ছেলে দাতা সদস্য শাহ ফজলে এলাহী ( যিনি রংপুর রেঞ্জে পুলিশের এএসআই পদে কর্মরত) এবং বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ছালেক লতিফ। বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিক ও একটি স্থানীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিধিমালা থাকলেও গোপনে এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে যা স্কুলটির শিক্ষক, এলাকাবাসী কেউই জানেন না।
চলতি বছরের গত ১০ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত বেসরকারি বিদ্যালয়ের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালার পরিপত্রে ২.২ “ক” ধারায় উল্লেখ রয়েছে, শূন্য পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য বহুল প্রচারিত ২ (দুই)টি দৈনিক পত্রিকায় (১টি জাতীয় পত্রিকা এবং ১টি স্থানীয় পত্রিকা) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও সম্ভাব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তির ব্যাপকপ্রচার করতে হবে। এবং ২.৩ এর “খ” ধারায় উল্লেখ রয়েছে, প্রাপ্ত আবেদনের সংক্ষিপ্ত তালিকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নোটিশ বোর্ড/ওয়েব সাইট-এ প্রকাশ করতে হবে।
কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে অতি গোপনে এই চার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ম্যানেজিং কমিটি। কবে কোন পত্রিকায় এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে তা জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারও মনে নেই বলে জানান। তবে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত করেন। অন্যদিকে দাতা সদস্য পুলিশ কর্মকর্তা শাহ ফজলে এলাহী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কথা স্বীকার করলেও পত্রিকার নাম বলেননি।
এদিকে শিক্ষাবার্তা’র হাতে আসা কল রেকর্ডের অডিও বার্তা’য় আর্থিক লেনদেন এবং কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে সে বিষয়ে প্রার্থী এবং বিদ্যালয়টির দাতা সদস্য পুলিশ কর্মকর্তা শাহ ফজলে এলাহীর কথোপকথনে নিয়োগ পাবেন কারা তাদের নাম এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি উঠে আসে।
ঐ অডিও রেকর্ডের সূত্র ধরে জানা গেছে, গোপন এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ পাচ্ছেন নিরাপত্তা কর্মী পদে একই ইউনিয়নের উত্তর পলাশবাড়ী এলাকার মিজানুর রহমানের পুত্র মাহাফুজার রহমান, এবং কিসমত ফতেজংপুর এলাকার মশিউর রহমানের পুত্র নুরজামান, নৈশ্য প্রহরী পদে কিং ফতেহজংপুর এলাকার ছলেমউদ্দিন শাহ’র পুত্র রেজানুল হক, আয়া পদে জোতরঘু এলাকার শ্রী মতি বিত্রিয়া বিশ্বাস, স্বামী শ্রী নারায়ন চন্দ্র এবং একই পদে জোতরঘু এলাকার শ্রী সুমন চন্দ্র রায়ের স্ত্রী শ্রীমতি সাধনা রানী ওপরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে কিং ফতেজংপুর এলাকার ওয়াহেদ আলীর পুত্র মোঃ আনারুল হক। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লেনদেন করে তাদের আবেদনের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।
তবে এই অডিও রেকর্ডের বিষয় অস্বীকার করে দাতা সদস্য পুলিশ কর্মকর্তা শাহ ফজলে এলাহী দাবি করেন, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানিনা, কল রেকর্ড আমার আপনারা কি ভাবে নিশ্চিত হলেন। তিনি দাবি করেন প্রত্যেক স্কুলে নিয়োগ এভাবেই হয়।
এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক একদিন আগে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে পার্শ্ববর্তী বীরগঞ্জ উপজেলার বীরগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এই নিয়োগে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পান ছালেক লতিফ। এই নিয়োগ নিয়ে বিজ্ঞ আদালতে মামলা চলমান রয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, প্রধান শিক্ষক ছালেক লতিফকে নিয়োগ দেওয়ার সময় আর্থিক লেনদেন তো হয়েছেই সে সময়ে মৌখিক চুক্তি করা হয়েছিল যে এই চার পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তিনি সহযোগিতা করবেন এবং তিনি এই লেনদেনের কোন অংশ পাবেন না। চুক্তি অনুযায়ী এই গোপন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করছেন প্রধান শিক্ষক লতিফ।
স্কুল সংলগ্ন বেশ কয়েক জনের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, এলাকার এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী পদে নিয়োগ হলে এলাকার মেধাবী যুবক-যুবতীরা আশায় থাকেন তাদের যোগ্যতায় তারা চাকরি পাবেন। অথচ কবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো তা আমরা জানতে পারলাম না। এটা কোন প্রক্রিয়া হতে পারে। আমরা অবিলম্বে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল চাই এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার দাবি জানাই যেন সবাই আবেদনের সুযোগ পান।
প্রধান শিক্ষক ছালেক লতিফের কাছে জানতে চাইলে তিনি রংপুরে চিকিৎসক দেখাতে গেছেন জানিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি।
বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হরমুজ আলী শাহ এর কাছে জানতে চেয়ে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে চিরিরবন্দর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফজলে এলাহী শিক্ষাবার্তা’কে জানান, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, কোন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে সেটি এই মুহুর্তে মনে নেই। নিয়োগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে কি’না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিজি প্রতিনিধি চাওয়া অনেক দুরের ব্যাপার। বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের একটি মামলা আছে, আগে সেটির সমাধান করে আসুক তারপরে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দেখা যাবে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০২/০৫/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.