এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি

আলী রেজাঃ শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য বর্তমান সরকার শিক্ষা কারিকুলাম ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। এতে পুরোনো অনেক কিছুই বাদ পড়েছে এবং নতুন অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে। পাঠদান প্রক্রিয়াও আর আগের মতো নেই। বদলে যাওয়া এই শিক্ষা কারিকুলামে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাকে শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অর্জিত শিক্ষা যাতে ব্যবহারিক জীবনে সরাসরি কাজে লাগানো যায় সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই শিক্ষা কারিকুলামে এ ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই মূল ভূমিকা পালন করবেন। তাই শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপরই নির্ভর করবে এর ভবিষ্যৎ।

নতুন কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনা গেলেও সংগত কারণেই শিক্ষকদের পরিবর্তন করা যাবে না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা যাবে মাত্র। সরকার সে চেষ্টাই করছে। দফায় দফায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানে ফিরে এসে সে অনুযায়ী পাঠদান করান না কিংবা করাতে পারেন না। তার মানে নিয়োগের সময় যদি অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে তাদের যতই প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক না কেন-তারা প্রশিক্ষণ অনুযায়ী পাঠদান করাতে ব্যর্থ হবেন। দেশে বর্তমানে প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। সম্প্রতি এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা পেয়েছে। কিন্তু তার আগেই জনবল কাঠামো অনুযায়ী প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি। বর্তমানে দেশের প্রায় পাঁচ লাখ বেসরকারি শিক্ষকের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখই ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। এই শিক্ষকরাই তিন থেকে চার দশক শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত থাকবেন। এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাদের শত চেষ্টা করেও যোগ্য করে গড়ে তোলা যাবে না। কারণ তারা নিজেরাই পেশাগতভাবে দক্ষ হয়ে ওঠার কথা চিন্তা করেন না। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট নয়-এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দিকেই তাদের আগ্রহ লক্ষ করা যায়। এসব শিক্ষক ভালোবেসে শিক্ষকতা পেশাকে গ্রহণ করেননি। ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির নিয়োগবাণিজ্যের মাধ্যমে এরা শুধু একটি চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষক হয়ে ওঠার কোনো ইচ্ছা বা প্রচেষ্টা নেই তাদের মধ্যে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দেখভাল করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অডিট শাখা আছে। এ শাখায় দায়িত্বপ্রাপ্ত অডিটররা শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। শোনা যায়, তারা মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে এই শাখায় বদলি হয়ে আসেন। পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অডিট করতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানের সব অনিয়ম জায়েজ করে অডিট রিপোর্ট প্রদান করেন। অডিটরদের এ ধরনের অনিয়মের ফলেই জাল সনদ নিয়ে বছরের পর বছর চাকরি করতে দেখা গেছে অনেক শিক্ষককে। অনেক দিন পরে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অডিট শাখার মাধ্যমে জানা গেছে জাল সনদ নিয়ে কর্মরত শিক্ষকদের তালিকা। এদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে বেতন-ভাতা ফেরতসহ প্রয়োজনীয় শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হলেও অতীত অভিজ্ঞতা সন্তোষজনক নয়। বিভিন্ন কৌশলে এরা পার পেয়েই যায়।

প্রকৃত মেধাবী ও নৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী অবস্থানে থাকা পেশাদারি শিক্ষকদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান রেখেই বলছি, বর্তমানে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ শুধু পাঠদানে দুর্বল নন, নৈতিক দিক দিয়েই যথেষ্ট দুর্বল। সম্প্রতি রাজধানীর একটি নামিদামি স্কুলে ছাত্রীদের সঙ্গে একজন শিক্ষকের যৌন-হয়রানির তথ্য প্রকাশ হয়েছে। গণমাধ্যমে এসে ছাত্রীরা বলেছে তাদের প্রতি যৌন-হয়রানির কথা। এর আগেও স্কুলটিতে এ ধরনের আপত্তিকর ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি আরও একটি ঘটনা ঘটেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ছাত্রীদের মধ্যরাতে চা-পানের দাওয়াত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তরঙ্গ ভিডিও লিংক শেয়ার, কুপ্রস্তাব ও যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। আর একটি সংবাদ শিক্ষক সমাজকে চরম লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। শিক্ষা বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা দৈনিক শিক্ষা ডটকম সংবাদটি প্রচার করেছে। সংবাদটি হলো-দাখিল পরীক্ষার্থীদের নকল দিচ্ছেন শিক্ষকরা। এ অনৈতিক বিষয়টির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অনৈতিক কাজ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে যা প্রায়ই গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়।

সব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। ফলে এসব ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকের এই অনাকাক্সিক্ষত যৌন হয়রানিমূলক আচরণ এখন শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। একশ্রেণির শিক্ষকের এ ধরনের নৈতিক অধঃপতনে পুরো শিক্ষক সমাজের মুখেই চুনকালি লেগে যায়। সর্বত্রই শিক্ষকতাকে একটি মহান ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে দেখা হয়। সবাই নিজেদের সন্তানকে শিক্ষকের কাছে পাঠান সুশিক্ষা গ্রহণের জন্য। সবারই প্রত্যাশা থাকে, শিক্ষকরা শুধু তাদের সন্তানদের একাডেমিক শিক্ষাই দেবেন না; সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও সচ্চরিত্র গঠনের শিক্ষাও দেবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের সে প্রত্যাশা পূরণ হতে দেখা যায় না।

এর কারণ অনুসন্ধান করার জন্য ব্যাপকভাবে সামাজিক গবেষণার প্রয়োজন। এককভাবে শিক্ষক দায়ী, নাকি সময় ও সমাজবাস্তবতা দায়ী-সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের জন্য শুধু সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে দায়ী করা চলে না। একজন বেকার যুবক কর্মসংস্থানের তাগিদ থেকে নিয়োগবাণিজ্যের ফাঁদে পা দিতেই পারে। কিন্তু নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো অনৈতিক কাজ করতে পারেন না। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে সেই অনৈতিক কাজটিই করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। ঢালাওভাবে বলা না গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনা, অর্থের লেনদেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পারিবারিক কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে দেখা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরগণ বিশ্ববিদ্যালয়কে আত্মীয়দের চাকরি সৃষ্টির কারখানায় পরিণত করেছেন বলেও অভিযোগ শোনা যায় সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। ব্যাকডোর দিয়ে নিয়োগ পাওয়া এসব শিক্ষক নানা ক্ষেত্রেই বেপরোয়া আচরণ করে থাকেন। তারা নিজেদের খুঁটির জোর প্রদর্শন করতেও ছাড়েন না। ফলে নৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে থাকা শিক্ষকরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় যোগ্যতা, দক্ষতা ও চারিত্রিক গুণাবলির নিরিখে শিক্ষক নিয়োগ জরুরি হয়েছে পড়েছে। জাতীয় স্বার্থে শিক্ষক নিয়োগকারী সব কর্তৃপক্ষকে সে জরুরি কাজটি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়োগের প্রক্রিয়া কয়েক ধাপে ফিল্টারিং করা যেতে পারে। প্রাথমিক নিয়োগ থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত যেকোনো পর্যায়ে যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি এবং চারিত্রিক বা আচরণগত স্খলনের কারণে নিয়োগ বাতিল হওয়ার বিধান করা যেতে পারে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ এত দিন শুধু প্রত্যয়ন করার কাজটি করত। আশার কথা হলো প্রতিষ্ঠানটি এখন বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়োগের ক্ষমতাও পেতে যাচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।

সরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও আছে নানা অভিযোগ। নানাভাবে অনৈতিক পন্থায় লিখিত পরীক্ষায় পাস করানো হয় এবং মৌখিক পরীক্ষায় পার করে দিয়ে চাকরি নিশ্চিত করা হয়। অনেক সময়ে এসবের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে নির্বাচিত প্রার্থীদের কাছ থেকেই জানা যায় অর্থ লেনদেনের ঘটনা। ফলে মেধাবী প্রার্থীদের বদলে চাকরি পেয়ে যায় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী প্রার্থীরা। চাকরি জীবনেও তারা অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠানে বদলিসহ নানা অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দিকে তাদের তেমন কোনো নজর থাকে না। ফলে প্রতিটি গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে সাধারণ মানুষ। কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট ও কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। একদিকে সরকার অভিভাবকদের শিক্ষাব্যয় হ্রাস করার লক্ষ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই ও উপবৃত্তি দিয়ে আসছে। অন্যদিকে সরকারি শিক্ষকদের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে শিক্ষাব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে অরাজকতা সবচেয়ে বেশি বলে বিশ্বাস করে অভিজ্ঞ মহল। রাজনৈতিক বিবেচনা আর স্বজনপ্রীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন নিয়োগ পদ্ধতি প্রণয়নের বিষয়ে চিন্তা করছে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসি কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বটি পালন করতে পারে। তবে যে কর্তৃপক্ষই শিক্ষক নিয়োগের কাজটি করুন না কেন-জাতীয় স্বার্থে সে কর্তৃপক্ষকে সব ধরনের অনিয়ম পরিহার করে চলতে হবে। একজন শিক্ষকের হাতেই আমরা তুলে দেই আগামীদিনের জাতি গঠনের গুরু দায়িত্ব। মহান পেশায় নিয়োজিত শিক্ষকরা প্রকৃতপক্ষেই মহান হয়ে উঠবেন-যদি তাদের সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সঠিক বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়।

লেখকঃ পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/০৩/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.