রাখাল রাহাঃ এই প্রশ্নটা অযৌক্তিক। কারণ হলো, শিক্ষক মানসম্পন্ন না হলে, শিক্ষার পরিবেশ মানসম্পন্ন না হলে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত যথাযথ না হলে কোনো কারিকুলাম বা পাঠ্যবই দিয়েই মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া যায় না। বরং এগুলো ঠিক থাকলে কারিকুলাম বা পাঠ্যবইয়ের ত্রুটি নিয়েও মানসম্মত শিক্ষার অনেকখানি অর্জন করা সম্ভব হয়। যেহেতু মানসম্মত শিক্ষার সকল শর্তই এখানে প্রতিকূল করে রাখা হয়েছে, স্কুলে ঠিকমতো ক্লাস হয় না, শিক্ষকেরা অনেকেই ঠিকমতো পড়ান না বা পড়াতে পারেন না, পড়ানোর পরিবেশ নেই, বইগুলো পড়ে ভালোমতো বোঝা যায় না, তাই অভিভাবকরা যে যেভাবে বুঝতেন স্কুলের বাইরে প্রাইভেট-গাইড-কোচিং ইত্যাদিতে ছুটে-ছুটে জীবন ক্ষয় করেও সন্তানের জন্য যতোখানি সম্ভব করতেন। তার সুযোগ আগের কারিকুলামের পাঠ্যবই, শিখন ও মূল্যায়ন-পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা হলেও ছিল। এবং তারও আগে, অর্থাৎ সৃজনশীলের আগে আরো বেশি ছিল।
নানা সময়ে আমাদের অভিভাবক-শিক্ষকদের সেই আত্মত্যাগের কৃতিত্বই সরকারগুলো বেহায়ার মতো গর্ব করে বলে বেড়াতো। কিন্তু বর্তমান কারিকুলামের মূল আঘাতটা করা হয়েছে নবম-দশম শ্রেণীতে গিয়ে এবং সেখানে পরিকল্পিতভাবে যেটা চাওয়া হয়েছে তা হলো, এদেশের সাধারণের সন্তানেরা যেন কোনোভাবেই উচ্চশিক্ষা নিতে না পারে এবং কেউ নিলেও যেন ভালো করতে না পারে। সেজন্য তারা যেটা করেছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান মিলিয়ে সবার জন্য একটাই কম্বাইণ্ড সাইন্স বানিয়েছে, এবং গণিত ও উচ্চতর গণিত মিলিয়েও সবার জন্য একটাই গণিত বানিয়েছে। যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ না করে মাধ্যমিক স্তর শেষেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে চায় তাদের জন্য সাধারণত এ ধরণের বই তৈরি করা হয়। নবম-দশম শ্রেণীর সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখেই তারা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই নির্মাণের কথাও বলছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়ার মতো বিস্ময়কর কথাও তাদের মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে। দ্বিতীয় যে বড়ো আঘাতটা তারা করেছে তা হলো, শিখন-শেখানো পদ্ধতি এমনভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি এমনভাবে সাজিয়েছে যা আগের চেয়ে ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত।
দুনিয়ার কোনো স্মার্ট কান্ট্রির পক্ষেই যখন এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, এমনটা তারা ভাবতেও পারেন না, এটার চেষ্টা করাও যেখানে গর্হিত কাজ, সেখানে আমাদের মতো এমন আনস্মার্ট হযবরল সরকার, মন্ত্রণালয় ও ব্যবস্থা দিয়ে এটা চরম হযবরল বানিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবাইকে সর্বশান্ত করে যখন শেষে গিয়ে ছাড়বে, তখন তা আর আগের জায়গায় ফিরবে না। এভাবেই আমাদের শিক্ষা ক্রমপতিত হতে থাকে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে। তবু কিছু মানুষ আছে, যারা বাইরের পোশাক আর শাসকের আশ্বাসে এখনো কি দারুণভাবে আশ্বস্ত হতে ভালোবাসে। এরা হয় ধুরন্ধর, নয়তো এই ব্যবস্থার শিকার নয়। মনে রাখা দরকার জাতীয় কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হয় পুরো জাতির কথা মাথায় রেখে ১% স্কুল, ১% শিক্ষার্থী, ১% অভিভাবক আর ১% শিক্ষকের কথা মাথায় রেখে নয়। শতভাগ সাফল্য অর্জন হয় না, কিন্তু তা অর্জনের লক্ষ্যে এক ভাগ গাফিলতিও এখানে দণ্ডনীয় অপরাধ। শিক্ষা নিয়ে ভয়াবহ অপরাধের কাজ সরকারগুলো বহুদিন থেকে করে আসছে এবং আরেকটা মহা ভয়াবহ কাজের এখন বাস্তবায়ন চলেছে। একে থামাতে হবে। এই কারিকুলাম বাতিল করতে হবে।
লেখকঃ আহ্বায়ক, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির) এবং সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
“মুক্তমত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.