শরীফুজ্জামান আগা খানঃ ২০২২ সালের ৬ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করে। এমপিওভুক্তির এ ঘোষণা বছরের পর বছর বিনা বেতনে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের মনে স্বস্তি আনে। তারা অচিরেই বেতনপ্রাপ্তির ব্যাপারে আশান্বিত হয়ে ওঠেন। তালিকা প্রকাশের পরই নতুন এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা এমপিও কোড পায় এবং শিক্ষক-কর্মচারীরা অনলাইনে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেতন পাওয়া শুরু করেন। এরপর বিলম্ব হলেও সম্প্রতি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিও পেয়েছেন। কিন্তু স্কুলের ক্ষেত্রে এলাকাবিশেষে স্বল্পসংখ্যক নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের একটি অংশের এমপিও চালু হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও এখনো চালু হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে দিনাতিপাত করছেন।
গত বছর ৩০ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা এক পরিপত্রে নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পাঠদান, একাডেমিক স্বীকৃতি, এমপিও কোড ও অন্যান্য কাগজপত্র এবং ব্যক্তি এমপিওর ক্ষেত্রে শিক্ষক-কর্মচারীদের সব পরীক্ষার সনদ/মার্কশিট ও নিয়োগসংক্রান্ত কাগজপত্র সরেজমিন যাচাইয়ের জন্য তিন স্তরবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। উপজেলা/থানা পর্যায়ে এ কমিটির সদস্যরা হলেন উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, ওই এলাকার সরকারি বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক এবং এমপিওভুক্ত উচ্চবিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক। উপজেলা/থানা পর্যায়ের পর জেলা পর্যায়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রধান করে অনুরূপ তিন সদস্যের কমিটি, এরপর অঞ্চল পর্যায়ে উপপরিচালককে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাগজপত্রের সঠিকতা যাচাই করাতে এ তিন পর্যায়ের কমিটির দ্বারস্থ হতে হয়। পরবর্তীকালে অনলাইনে এমপিও আবেদনের অনুমতি মিলে। অনলাইনে এবারে নয় উপজেলা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে আবেদন উপপরিচালকের দপ্তরে যাচ্ছে। অথচ মাদ্রাসার ক্ষেত্রে কেবল উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে অনলাইনে আবেদন করতে পেরেছিল। কলেজেরও স্কুলের মতো আবেদনে এত ঝক্কি পোহাতে হয়নি।
কোনো একটি অফিসে এমপিওর আবেদন নিয়ে গেলে ওই অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনে করেন, এমপিওপ্রত্যাশীরা তাদের দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র। তারা যথেচ্ছ আচরণ করেন। অসদাচরণের শিকার হলেও শিক্ষক-কর্মচারীরা দিনের পর দিন অফিসে ঘুরতে বাধ্য হন। অফিস ম্যানেজ করতে কাকুতিমিনতি করা লাগে। এ ম্যানেজ করার কাজে আবেদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া ঘুস দেওয়া লাগে। নতুন প্রতিষ্ঠানের অনলাইনে এমপিওর আবেদন করতে এবার উপপরিচালকের দপ্তর থেকে পাসওয়ার্ড নম্বর সংগ্রহ করতে হয়েছে। অঞ্চলবিশেষে বড় অঙ্কের অর্থ ছাড়া এ পাসওয়ার্ড মেলেনি। অথচ ২০১৮ সালের এমপিওর ক্ষেত্রে কমন পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল।
কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের এমপিওপ্রত্যাশী শিক্ষক-কর্মচারীদের সংখ্যার ওপর মাথাপিছু হিসাব করে ঘুসের অঙ্ক নির্ধারণ করা হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজনের এমপিওর আবেদন সম্পন্ন করতে প্রদেয় ঘুসের পরিমাণ ৬০ হাজার টাকার ওপর। মাধ্যমিক স্তরে তিনজন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হবেন এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক জানালেন, তার উপজেলার শিক্ষা অফিসের কম্পিউটার অপারেটরের সঙ্গে জনপ্রতি ৭০ হাজার টাকার ঘুসের প্যাকেজে এমপিওর কাজ সম্পন্ন করার চুক্তি হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিস এবং উপপরিচালকের দপ্তরের সঙ্গে ওই অপারেটরের লিঙ্ক রয়েছে। নতুন এমপিওভুক্ত একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ঘুস দিয়েও কাজ করাতে পারেননি। ঘুসের টাকা মার গেছে। তিনি খেদোক্তি করলেন, ঘুস তো দিতেই চাই; কিন্তু কার কাছে দেব সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। এক একটা অফিসে ঘুস নেওয়ার একাধিক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। সাধারণত কর্মকর্তারা সরাসরি ঘুসের টাকা গ্রহণ করেন না। অফিস সহকারী, ড্রাইভার কিংবা অফিস সহায়কের মাধ্যমে এ অর্থ নিয়ে থাকেন। এসব মাধ্যম আবার ঘুসের টাকা বসের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন না করলে জটিলতা দেখা দেয়। তবে সব ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা যে রাখঢাক করে ঘুস খাচ্ছেন তা-ও নয়। একজন প্রধান শিক্ষক জানালেন, আমাদের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আজান দিয়ে ঘুস খাচ্ছেন। কোনো মাধ্যম নয়, তিনি সরাসরি খাম গ্রহণ করছেন। পুলিশের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা যেমন লোভনীয় স্থানে চাকরি করার উদ্দেশ্যে তদবির করে বদলি কিংবা পদায়িত হয়ে আসেন, তদ্রূপ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং উপপরিচালকের পদেও অনুরূপ বদলি কিংবা পদায়িত হয়ে আসার ঘটনায় দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিশিয়াল কাজে শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
অনলাইনে উপজেলা/থানা, জেলা ধাপ পেরিয়ে উপপরিচালকের কাছে আবেদন গেলে নানা ছুতোয় তা রিজেক্ট করা হচ্ছে। ফাইল রিজেক্ট করার নানা কারণের কয়েকটি হলো-আবেদনকারীর কোনো একটি সনদের বিষয়ে আপত্তি তোলা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএড সনদ কিংবা গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানে সনদ থাকলে ফাইল রিজেক্ট করা হচ্ছে। অথচ কোনো প্রার্থীকে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে পাঁচ সদস্যের যে নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হয়েছিল, ওই বোর্ডে ডিজির প্রতিনিধি এবং উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা সদস্য হিসাবে ছিলেন। প্রার্থী নির্বাচনে তাদের স্বাক্ষরসংবলিত নির্বাচনি পরীক্ষার ফলের সিট জমা দেওয়া হয়েছে। সনদের বিষয়ে আপত্তি থাকলে সে সময়ই নিয়োগ আটকে দেওয়া ছিল সংগত। বোর্ডে সনদ যাচাই করতে হবে জানিয়ে ফাইল রিজেক্ট করা হচ্ছে। অথচ উপজেলা ও জেলা কমিটি ইতঃপূর্বে মূল কাগজপত্র যাচাই করে দেখেছে। ব্যানবেইসের হার্ডকপি জমা না দেওয়ার কারণ দেখিয়ে ফাইল রিজেক্ট করার ঘটনাও ঘটছে; কিন্তু আবেদনের শর্তে ব্যানবেইসের হার্ডকপি জমা দেওয়ার কথা বলা হয়নি। আর ব্যানবেইসে কারও নাম আছে কি না, সেটা তো ব্যানবেইসের ওয়েবসাইটে গিয়ে উপপরিচালকরাই মিলিয়ে নেওয়ার কথা। এমপিও নীতিমালায় নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের যথাক্রমে ৯ম ও ৮ম গ্রেডে বেতন স্কেলের উল্লেখ রয়েছে। নির্ধারিত গ্রেডে আবেদন করলে ফাইল রিজেক্ট করে একধাপ নিচে আবেদন করতে বলা হচ্ছে। একবার ফাইল রিজেক্ট করলে পরবর্তীকালে আবারও আবেদনের ধাপ সম্পন্ন করতে দুই মাস সময় লাগে, সেই সঙ্গে হয়রানি আর বাড়তি খরচ তো আছেই। কোনো প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক-কর্মচারীর একযোগে এমপিওভুক্ত না করে কিছুসংখ্যককে এমপিওভুক্ত করায় বঞ্চিতরা হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওপ্রাপ্তিতে নতুন বছরে বই উৎসবের মতো যে উৎসব হওয়ার কথা ছিল, সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা থাকলে একটি জরিপের ভেতর দিয়ে কিংবা অভিযোগ সেল গঠন করে এমপিওবিষয়ক দুর্নীতির চিত্র সম্পর্কে অবহিত হয়ে প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ঘোষণার এক বছর পর গত ৯ জুলাই নতুন এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া সময়োপযোগী করা সংক্রান্ত কর্মশালার আয়োজন করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রধান অতিথি ছিলেন। এ কর্মশালায় ৫৬ জন কর্মকর্তা/প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের সূত্রে জানা যায়, এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য আবেদনের ধাপ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান সরাসরি মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে পারবেন। আবেদনে ৩৩ দফার বিপুলসংখ্যক কাগজপত্রের পরিবর্তে মূল কাগজপত্র জমা দিলেই চলবে। এরিয়ারসহ বিল দেওয়া হবে ইত্যাদি। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এসব সিদ্ধান্তের কোনো পরিপত্র এখনো জারি হয়নি। ফলে ওই কর্মশালায় গৃহীত সিদ্ধান্তের সুফল এমপিওপ্রত্যাশী শিক্ষক-কর্মচারীরা পাননি।
গত বছরের ৬ জুলাই এমপিওভুক্তির ঘোষণা আসে। এরপর ১৪ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে আর মাত্র দুই মাস বাকি। স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে ভীষণ হয়রানি, দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতার শিকার হচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে এ সরকারের মেয়াদে নতুন এমপিওভুক্ত নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওবঞ্চিত থেকে যাবেন।
লেখকঃ শিক্ষক ও গবেষক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.