।। মনিরুল মোমেন।।
নম্বর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট ও সন্তুষ্ট হয় বাংলার নম্বর দেখে। সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেলেও অনেকেই বাংলাতে পায় না। আবার কেউ কেউ কোনো বিষয়ে তেমন ভালো নম্বর না পেলেও বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বসে। জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্টের দিন এই পাওয়া না পাওয়ার অনেক আক্ষেপ-আনন্দ সকলেই দেখতে পাই। অনেকে বেশ ভালো লিখেও আশানুরূপ নম্বর পায় না আবার অনেকেই গড়পড়তা লিখে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বসে। এর মূলে রয়েছে উত্তরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। যথাযথ মূল্যায়নের অভাবেই এমনটি হয়ে থাকে।
আজ আমরা সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তপত্র মূল্যায়ন ও নম্বর প্রদান সম্পর্কে আলোচনা করবো।
বাংলা এমন একটি বিষয়, যেখানে সবচেয়ে বেশি গড় নম্বর প্রদান করা হয়। মনগড়া নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলা অদ্বিতীয়। কোনো এক প্রশিক্ষণে দেখেছি, একটি বাংলা সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরপত্র ফটোকপি করে বিশ জন শিক্ষককে মূল্যায়ন করতে দেয়া হয়। সেখানে সর্বনিম্ন নম্বর দেয়া হয় ৬ আর সর্বোচ্চ ৯। ১০ নম্বরের একটি প্রশ্নে ৩ নম্বরের হেরফের। তাহলে সাতটি প্রশ্নে অর্থাৎ ৭০ নম্বরে তারতম্য হবে ২১ নম্বরের। একই উত্তরপত্রে কেউ পেতে পারে ৬৩ আবার কেউ ৪২।
বাংলা বিষয়ের নম্বরের ক্ষেত্রে এই তারতম্য বহুকালের পুরনো। এর মূলে রয়েছে মূল্যায়নকারীর অবিবেচনা ও মূল্যায়নের অদক্ষতা। পরীক্ষকের নানা রকম ঘাটতির কারণেই অনেক শিক্ষার্থী বাংলায় কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকে বঞ্চিত হয়। আবার অনেকে অনাকাঙ্ক্ষিত নম্বর পেয়ে বসে। উত্তপত্র মূল্যায়নকারী শিক্ষকদের সমবিবেচনার অভাবেই এমনটা হয়ে থাকে। এর পেছনে নিম্নোক্ত কারণগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে:
১। পরীক্ষক সৃজনশীল উত্তপত্রের নম্বর প্রদান পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধরণা রাখেন না।
২। পরীক্ষক নিজেই সঠিক উত্তর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না।
৩। তিনি হয়তো দায়সারাভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে থাকেন।
৪। তিনি শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক নানা কারণে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে থাকেন।
৫। তিনি হয়তো তাড়িঘড়ি করে উত্তপত্র মূল্যায়ন শেষ করতে চান।
৬। তিনি হয়তো ব্যক্তিক, পারিবারিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক চাপের মুখে উত্তপত্রগুলো মূল্যায়ন করে থাকেন।
৭। তিনি হয়তো প্রতিকূল পরিবেশ, পাবলিক প্লেস কিংবা যানবাহনে বসে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন।
৮। তিনি হয়তো শিক্ষার্থীর সুন্দর কিংবা অসুন্দর লেখা দেখে গড়পড়তা নম্বর প্রদান করেন।
আমরা জানি, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে একটি উদ্দীপককে কেন্দ্র করে চারটি প্রশ্ন থাকে। যার ক ও খ (জ্ঞান, অনুধাবন) পাঠনির্ভর। গ ও ঘ (প্রয়োগ, উচ্চতর দক্ষতা) পাঠ ও উদ্দীপক নির্ভর। চারটি প্রশ্নে সুস্পষ্ট নম্বর বিভাজন রয়েছে। একজন পরীক্ষক তাঁর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সুবিবেচনা দ্বারা যথাযথ নম্বর প্রদান করবেন। এখানে খুব বেশি তারতম্য হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অনেক পরীক্ষকই উত্তরপত্র না পড়ে ১+১+২+৩/ ১+১+২+২/১+২+২+২/ ১+২+২+৩ এই ফর্মেটে গদবাধা নম্বর প্রদান করে থাকেন, যা অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ। তবে কতিপয় পরীক্ষক যথেষ্ঠ দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে থাকেন।
বাংলা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র মূল্যায়নের জন্য বোর্ড, এনসিটিবি ও বিশেষজ্ঞগণ নানা সময়ে নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশনাগুলে কমবেশি সকলেরই জানা। একটি পাবলিক পরীক্ষার উত্তপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সে নির্দেশনা পরীক্ষকের মেনে চলা উচিত।
আসুন, এবার বাংলা সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও নম্বর প্রদান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করি।
প্রত্যেক পরীক্ষককে সৃজনশীল প্রশ্নের নম্বর বিভাজনটা মাথায় রাখতে হবে। একটি ১০ নম্বরের সৃজনশীল প্রশ্নে ৪ নম্বর থাকে জ্ঞানের, ৩ নম্বর অনুধাবনের, ২ নম্বর প্রয়োগের ও ১ নম্বর থাকে উচ্চতর দক্ষতার। তাহলে ৭টি সৃজনশীল প্রশ্নে অর্থাৎ ৭০ নম্বরের মধ্যে জ্ঞানমূলক থাকে ২৮, অনুধাবন ২১, প্রয়োগ ১৪ ও উচ্চতর দক্ষতা ৭।
ক) জ্ঞানমূলক প্রশ্ন:
আমরা সকলেই জানি, জ্ঞানমূলক প্রশ্নের মান ১। এই প্রশ্নে পাঠ্যবইয়ের এমন একটি তথ্য জানতে চাওয়া হয়, যার সঠিক উত্তর সুনির্দিষ্ট। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের জন্য শিক্ষার্থী পূর্ণ নম্বর অর্থাৎ ১ পাবে। যদি উত্তর লিখতে গিয়ে কোনো একটি বানান ভুল করে, তবু সে পূর্ণ নম্বরই পারে। কারণ, অর্ধেক নম্বর দেয়ার সুযোগ নেই।
উত্তরের তথ্যটি ভুল লিখলে কোনো নম্বর পাবে না।
খ) অনুধাবনমূলক:
শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয় এই অংশে।বেশিরভাগ শিক্ষক অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তরে ১ নম্বর দিয়ে থাকেন। বিষয়টা অত্যন্ত অবিবেচনার। অনুধাবনে সবাইকে ঢালাওভাবে ১ নম্বর দেয়ার মানসিকতা পরিহার করা উচিত।
আমরা জানি, অনুধাবনমূলক প্রশ্নের মান ২। এই ২ নম্বর দুইভাবে বিভক্ত। অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তরেও একটি জ্ঞানমূলক প্রশ্ন থাকে, যার মান ১। বাকি ১ হলো অনুধাবন দক্ষতার জন্য। একজন শিক্ষার্থী যদি অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তরে কেবল এক লাইনে জ্ঞানমূলক উত্তরটা লিখে, তাতেও সে ১ পাবে। শিক্ষার্থী যদি অনুধাবন অংশটি যথাযথভাবে লিখে, তাহলে ১+১=২ অর্থাৎ পূর্ণ নম্বর পাবে।
তবে, কোনো শিক্ষার্থী যদি জ্ঞানের অংশটা সঠিকভাবে লিখে এবং অনুধাবনের অংশটা সাধারণ মানের লিখে, তারপরও সে ১+১ অর্থাৎ ২ পাবে। কারণ ১.৫ নম্বর প্রদানের সুযোগ নেই।
কেউ যদি জ্ঞানের অংশটা ভুল লিখে অনুধাবনের অংশ যথাযথ লিখে তাহলে পাবে ১।
জ্ঞানের অংশ ভুল লিখে অনুধাবনের অংশ সাধারণ মানের লিখেলেও ১ পাবে। এখানেও অর্ধেক নম্বর প্রদানের সুযোগ নেই।
যদি জ্ঞান ও অনু্ধাবনের কোনো অংশের উত্তরই প্রাসঙ্গিক না হয়, তাহলে কোনো নম্বর পাবে না। অর্থাৎ শূন্য পাবে।
গ) প্রয়োগমূলক:
প্রয়োগমূলক প্রশ্নের নম্বরের মান ৩। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, অধিকাংশ পরীক্ষক এই প্রশ্নে গড় নম্বর ২ দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ ১ নম্বরও দেন। এটাও মারাত্মক অবিবেচকের কাজ। প্রয়োগের ৩ নম্বরে তিনটি বিভাজন রয়েছে। জ্ঞান ১, অনুধাবন ১, প্রয়োগ ১। এখানেও অনুধাবনের মতো প্রতি অংশের জন্য আলাদা নম্বর পাবে। ১, ২, ৩ যেকোনো নম্বর পেতে পারে। মূল্যায়নের সময় অবশ্যই অংশ বিবেচনা করে নম্বর প্রদান করতে হবে।
উত্তর একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হলে কোনো নম্বর পাবে না।
ঘ) উচ্চতর দক্ষত:
উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্নের মান ৪। শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত হবার আরেকটি জায়গা এটি। কোনো রকম বিবেচনা না করেই অধিকাংশ পরীক্ষক এখানে ২ নম্বর দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ দেন ৩।
সকলেরই জানা, উচ্চতর দক্ষতার নম্বরে চারটি বিভাজন থাকে। জ্ঞান ১, অনুধাবন ১, প্রয়োগ ১, উচ্চতর দক্ষতা ১। নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে এই কাঠামোর বাইরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অনেকেই এই বিভাজন আমলে না নিয়ে গড়পড়তা ১, ২, ৩ নম্বর প্রদান করেন। একজন পরীক্ষককে অবশ্যই বিবেচনা করে নম্বর দিতে হবে।
লক্ষণীয়:
দুচারটে বানান ভুল থাকলে এর জন্য নম্বর কাটার কোনো বিধান নেই। কোনো বোর্ড এই নির্দেশনা দেয়নি। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা বাংলা সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স করেনি কিংবা শিক্ষকের মত দীর্ঘদিন বাংলা চর্চা করেনি। তবে, অধিক বানান ভুল ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাক্যের জন্য ১ নম্বর কটা যেতে পারে।
অনেক পরীক্ষক হাতের লেখার ধরন দেখে নম্বর প্রদান করেন। এই বিষয়টা একেবারেই বিবেচনায় নেয়া যাবে না। হাতের লেখা সুন্দর-অসুন্দরের সাথে নম্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। সবার লেখা যেমন সুন্দর হবে না, তেমনই সবার লেখা অসুন্দরও হবে না।
নীল, সবুজ কালির ব্যবহার কিংবা অব্যবহার নম্বরের তারতম্য ঘটায় না। কোনোভাবেই এতে উচ্ছ্বসিত বা বিরক্ত হয়ে নম্বরের তারতম্য করা যাবে না।
জেন্ডার ফেসিনেশন, স্বজনপ্রীতি ও রুষ্ট-তুষ্ট হয়ে নম্বরের হেরফের করা যাবে না। এতে একজন পরীক্ষকের নৈতিক মুত্যু হয়।
লেখক-
মনিরুল মোমেন
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ;
ক্যামব্রিয়ান কলেজ, ঢাকা।
প্রধান পরীক্ষক; মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.