ড. হাসনান আহমেদঃ অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন কলামে এদেশের সংস্কার নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথাই লিখেছি। অনেকে লেখাগুলো পড়ে অনেক ভালো ভালো মন্তব্য করেছেন। এ ধরণের পাঠকের সংখ্যাও শত শত। আমি তাদের প্রতি সম্মান রেখে একটা কথাই বলেছি, এদেশে যারা সংবাদপত্রে প্রকাশিত দেশ-গঠনোপযোগী কলাম পড়েনÑ তাদের হাতে সময় আছে, মন আছে, পড়ার মতো ধৈর্য আছে। কিন্তু তাদের হাতে কাজটা বাস্তবায়ন করার কোনো ক্ষমতাই নেই। এদেশে যারা আদেশ-নিষেধ, নিয়ম-নীতি তৈরি করতে সক্ষম, মানুষকে মানাতে সক্ষম, ক্ষমতাধর, তারা প্রকাশিত গঠনমূলক লেখা পড়েন না, হয়তো তাদের হাতে লেখা পড়ার অত সময় নেই কিংবা ইচ্ছে করে ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য লেখাগুলো পড়েও তুচ্ছ গণ্য করেন। নিজে বড় বুঝিÑ এ মনোভাব নিয়ে বড় চেয়ার দখল করে আছেন। জানিনা, আমার পাঠকসমাজ আমার এ উত্তরে সন্তুষ্ট কিনা।
দাদির কবর ছেড়ে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কান্নাকাটি করা আমাদের দেশীয় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অপারেশন দরকার হৃদপিÐে, অপারেশন করি পায়ের কণিষ্ঠ আঙুলে। এ স্বভাব আমাদের আছে। কত রকমের উদাহরণ দিয়ে, কখনো রসিকতা করে, কখনোবা কবিতা-গান লিখে অনেক সত্য-বাস্তবধর্মী, প্রয়োজনীয় কথা বলি। কারো স্বার্থবিরোধী হলে, আঘাত লাগলে তারা এড়িয়ে যেতে পারেন, গুরুত্ব নাও দিতে পারেন। মানুষের স্বভাব কি বদল হয়! মরণের আগ পর্যন্ত অতি কটু-সত্য কথা সময় পেলেই লিখে যাব। এটা আমার খারাপ স্বভাবের একটি। এদেশে সংস্কারের জোয়ার চলছে। অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব যে এর মধ্যে নেই, তাও নয়। কিন্তু বাঞ্চিত লক্ষ্যে পৌছানো অনেকটাই সম্ভব হবে না বলে মনে মনে জানি। আবার একটা গান শোনায়। ছোটবেলায় রামপ্রসাদী শুনতে যেতাম। মক্কা-কাশী, গয়া যাওয়া অপরাধ নয়, মন সুন্দর না হলে যাওয়া অনর্থক সময়ক্ষেপণ, টাকা-পয়সা নষ্ট। গায়ক গাইতেন, ‘মক্কা-কাশী-শ্রীবৃন্দাবন, অকারণ ঘুরে ঘুরে মরণ, আগে নিজের স্বভাব সুন্দর কর, তারপর গুরুর চরণ ধর, মক্কা-কাশি…’। আসলে রাজনীতিকদের মন-মানসিকতা দেশ-গড়ার উপযোগী না হয়ে ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’ হলে এদেশ কখনোই ভালো হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান যে ক’দিন ভালো কাজ করবেন, দেশ ভালো থাকবে। এর পরের কথা, আবার সেই ‘মহান রাজনীতিকদের কৃতকর্মের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। এদেশের সামাজিক মূল্যবোধ তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। রাজনীতিকরা সুশিক্ষিত নতুন লোকজন দলে আনছেন না। সংস্কার এড়িয়ে যাবার শতেক পথ সুবিধাভোগীরা অতি অল্প দিনে বের করে ফেলবে। প্রশাসনের অবস্থাও তো আগের মত রয়ে গেছে। তাহলে খাতাপত্রে শুধু সংস্কার করে বাস্তবায়ন করতে না পারলে সে সংস্কারের মূল্য কোথায়? আমি যে একটা কথা প্রায়ই বলি, সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে, মানুষের মন-মানসিকতায় ব্যাপক পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, অধিকাংশ লোকের কথার সাথে কাজের একবিন্দুও মিল নেই, যে কোনো সময় জিভ ঘুরিয়ে উল্টো কথা জনসমক্ষে বলে দিতে পারে, কোনো আত্মজিজ্ঞাসা নেই, এসব তো সমাজেরই অধঃপতন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়Ñ একথা কেউ কানে তোলে না, বিবেচনাও করে না, করার কথাও না। সমাজ পরিবর্তনশীল, এর একটা গতি আছে, এদেশে এর নেগেটিভ পরিবর্তন হয়ে এত নীচে নেমে গেছে যে মূল্যবোধের ব্যাপক অধঃপতন হয়েছে। আমরা ডাস্টবিনের ময়লাকে বজায় রেখে আতর ছিটিয়ে সুগন্ধে ভরে দিতে চাইÑ প্রকৃতির নিয়মে কী বলে? আগে ময়লাটাকে ঝেটিয়ে, ধুয়ে-মুছে বিদায় কর, তারপর যত পারো আতর ছিটাও। আমরা বুঝি, কিন্তু কাজটা সেমত করিনে। একমাত্র এদেশের ‘অতিমহান রাজনীতিকরা’ই দীর্ঘ ৫৪ টা বছর তাদের বিকৃত চিন্তাধারা, মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা, দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থ, বিবেকের অপমান করে ভালো সাজার ধুয়া তুলে এ অবস্থা তৈরি করেছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কীইবা করার আছে। সাধারণ মানুষ কেউ কেউ সমাজ থেকে জিভ উল্টানো, কথা ঘোরানো, মিথ্যাবাদিতা শিখছে, কেউবা শততার প্রিজারভেটিভ মেখে অতি কষ্টে পেঁচার মতো খোঁড়লে বসে দিনাতিপাত করছে। কেউ মরে বাঁচছে। দুর্নীতিবাজ, রাজনৈতিক টাউট বলতে আমি কিন্তু খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাই না। এরা অন্যদের অপকর্মের বলি। বলতে চাই, সমাজে রাজনৈতিক টাউট-বাটপার, চাঁদাবাজ, মিথ্যাবাদী-প্রতারকে ভরে গেছে। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ না করলে, রাজনীতি থেকে এদের বিতাড়িত না করলে, ভালো সুশিক্ষিত লোকজন জনসেবাই এগিয়ে না এলে, এদেশ আপনা-আপনি ভালো হয়ে যাবে, আমি আদৌ বিশ্বাস করিনে। এই অধম মাস্টারসাহেবের মতো এদেশের আরো হাজার হাজার সমাজ-সচেতন, সমাজ-পর্যবেক্ষক তা বিশ্বাস করতে পারেন না। যদি বিশ্বাস করেন, তারা সমাজ-পর্যবেক্ষক নন। আমি সমাজের অন্যায়-অত্যাচার, ঘুষবাণিজ্য, চাটুকারিতার ঘোর বিরোধী। কিন্তু মুখের কথায় কী লাভ বলুন। মানুষের কাছে দিনে দিনে খারাপ হয়ে যেতে হয়। হলুদ জামা পরে আধুনিক প্রগতিশীল সেজে সব খারাপের মধ্যেও অনুবিক্ষণ যন্ত্র চোখে লাগিয়ে ভালো কিছু খুঁজে বের করতে পারিনে। চোখে যা দেখি, কাঠকে কাঠ বলি, লোহাকে লোহা।
কয়েকদিন আগেও জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে কলাম লিখলাম, দেশের সংস্কার করতে হলে রাজনীতিবিদদের জন্য প্রফেশনাল এথিক্স, কোড অব কন্ডাক্ট আইন আকারে তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দল ও তার নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়া বা প্রসিডিউর থাকবে। রাষ্ট্র সে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ কঠোরভাবে করবে। শত্রæর ক্ষেত্রেও যা, আপন বাপের ক্ষেত্রেও তা। অন্য একটা পত্রিকায় রাজনীতিকদের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে লিখেছি। এখনো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কোনো ফল আসেনি। ভবিষ্যত দেশ কীভাবে ভালো চলা সম্ভব, মাথায় ঢোকে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দল-সংস্কার আন্দোলন করা দরকার। এজন্যই বারবার বলি বিপ্লব পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের মুখের কথার ওপর নির্ভর করে দেশ চলতে পারে না। নইলে রাজনৈতিক দলের রাজনীতিতে যে লুটপাট, দুর্নীতি, মিথ্যাচার শুরু হয়ে গেছে, এটা কখনোই দূর হবে না। সংশ্লিষ্ট কমিশনের এত মিটিং চলছে, সে কথা কেউ বলছেন না। সব অফিস-আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির ক্ষেত্রেও কঠোর আইন তৈরি করতে হবে ও তার নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে হবে। নইলে দেশের সাধারণ মানুষ ট্যাক্স দেয়, আর অবৈধ সম্পদ গড়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ‘কুতে মরে হাঁস আর ডিম খায় দারোগা বাবু।’ প্রয়োজনীয় ও ধন্বন্তরী সংস্কার হোক। ‘অতি মহান’ রাজনীতিকরা অনুমোদন না দিলে অনুমোদন নিতে হবে গণভোটের মাধ্যমে। রোগীর হাতে প্রেসক্রিপশনের ভার ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তাহলে রোগী বেছে বেছে মিষ্টি ওষুধগুলোর ব্যবস্থাপত্র নিজ হাতে লিখবে। দেশের রোগগুলো আগে শনাক্ত হোক, তারপর রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা হোক। ‘ডান্সিং এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ক’ করে পরিশ্রম বেশি, লাভ কম। এসব সাদামাটা কথায় গুরুত্ব দিলে লাভের সম্ভাবনা বেশি। ব্যালান্স অব পাওয়ার নিশ্চিত করার জন্য এ মূহুর্তে দাবী প্রেসিডেন্ট শাসিত শাসন ব্যবস্থা ও বিভিন্ন জটিলতায় না গিয়ে ‘জাতীয় সরকার’, যার অঙ্গিকার আন্দোলনের সময় বিএনপি করেছিল।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ
“মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৮/০৫/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.