এইমাত্র পাওয়া

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

ড. মাহরুফ চৌধুরী: নর ও নারীর সম্পর্ক কেবল প্রাকৃতিক নয়, বরং মানব সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই এটি সমাজগঠনের একটি মৌলিক ও অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই সম্পর্কের মূল স্বরূপ সহাবস্থান ও পরিপূরকতার, প্রতিযোগিতার নয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- তিনটি স্তরেই নর ও নারীর আন্তঃসম্পর্ক একটি ভারসাম্যমূলক কাঠামো নির্মাণ করে, যা মানবিকতার ধারক ও বাহক। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে একধরনের কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মতাদর্শিক প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে নর ও নারীকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই মতাদর্শের শেকড় আধুনিক উদারনৈতিক দর্শনের (লিবারালিজম) মধ্যে নিহিত, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের নামে সামাজিক সম্পর্ক, পারিবারিক বন্ধন এবং সম্মিলিত জীবনের কাঠামোকে ভেঙে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়।

‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ (ইনডিভিজুয়েলিজম) যেভাবে একক স্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেয়, তাতে সম্পর্কের পারস্পরিকতা ও দায়িত্ববোধকে উপেক্ষা করে কেবল ‘আমি’র অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামই মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে নারীর অগ্রগতিকে প্রায়শই পুরুষ কর্তৃত্ব ভাঙার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, আবার পুরুষের অর্জনকে ব্যাখ্যা করা হয় নারীর সম্ভাবনা দমনের ফল হিসেবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল নর-নারীর স্বাভাবিক সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে না, বরং পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার জায়গায় জন্ম দেয় অবিশ্বাস, সংকট ও দ্বন্দ্ব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পরিবারভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ধ্বংস কোনও জাতির দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণ আনতে পারেনি। আর সে কারণেই টেকসই ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য আমাদেরকে এ ধরনের মতাদর্শিক বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি।

তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে—প্রকৃত বাস্তবতা আসলে কী? প্রকৃতি কি কখনও দ্বন্দ্ব, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা আধিপত্যের ভিত্তিতে সৃষ্টিকে গড়ে তোলে? প্রকৃতির নীতিমালা বরং সামঞ্জস্য, পরিপূরকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন সূর্য ও চন্দ্র, দিন ও রাত, বৃষ্টি ও রোদ- প্রতিটি সত্তা তাদের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেও একে অপরের পরিপূরক হয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তবতা নির্মাণ করে। যাকে আমরা বলতে পারি, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’। একইভাবে নর ও নারী- এই দুই ভিন্ন জৈবিক সত্তার সম্মিলনে সৃষ্টি হয় মানবজীবনের পূর্ণতা। মানুষ কেবল শারীরিক বা জৈবিক সত্তা নয়, বরং মনন, অনুভব, নৈতিকতা ও সংস্কার- এই চারিত্র্যিক উপাদানসমূহের সম্মিলিত বিকাশই তাকে ‘মানুষ’ করে তোলে। এই বিকাশে নারী ও পুরুষ উভয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও শক্তির অবদান অপরিহার্য। একারণেই বহু ভাষায় ‘মানুষ’ শব্দটি ক্লীব লিঙ্গে ব্যবহৃত হয়, এটি কেবল ভাষাগত কাকতালীয় ব্যাপার নয়, বরং এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে মানুষের পরিচয় কোনো একক লিঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, বরং নারী ও পুরুষের সম্মিলিত অস্তিত্বই মানবতার পূর্ণ রূপ নির্মাণ করে।

নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা ও সম্মান দেওয়াই হচ্ছে নারীর প্রকৃত মুক্তি র প্রথম পদক্ষেপ। প্রকৃতপক্ষে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়, বরং সমান মর্যাদার সহযাত্রী ও সহযোগী হিসেবে দেখতে হবে। লিঙ্গের বিভাজনের রাজনীতি নয়, বরং নর ও নারীর যৌথ স্বার্থে সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়েই নারীর মুক্তি ও মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব। নারী ও পুরুষের এই মানবিক বন্ধনই পারে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিতকে টেকসই করে তুলতে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আধুনিক ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা নর-নারীর স্বাভাবিক পারস্পরিক নির্ভরতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধনকে অস্বীকার করে, তাদের সম্পর্ককে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কাঠামোয় রূপ দিতে চাইছে। সম্পর্কের মূল ভিত্তি যেখানে হওয়া উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সেখানে সেটিকে রূপান্তর করা হচ্ছে প্রতিপক্ষতার মনোবৃত্তিতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; এটি ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোতেও। গণমাধ্যম, জনপ্রিয় সাহিত্য এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার নির্দিষ্ট কিছু শাখাও এই কৃত্রিম দ্বন্দ্বচেতনার বাহক হয়ে উঠছে, যেন সচেতনতা মানেই দ্বন্দ্ব, প্রতিরোধ মানেই বিরোধিতা।

কিন্তু বাস্তবজীবন তার সম্পূর্ণ বিপরীত সত্য উদঘাটন করে। একজন পুরুষের সংবেদনশীলতা, নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণে ‘নারী’ পরিচয়ের চারটি রূপ- মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা- অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রাখেন। তেমনি একজন নারীর জীবন ও মানসিক গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে তাঁর পিতা, ভাই, স্বামী ও পুত্রের সম্পর্ক। এই পারস্পরিক নির্ভরতা এবং আন্তরিকতা সামাজিক ভারসাম্যের মূল ভিত্তি, যা বিনষ্ট হলে তৈরি হয় সম্পর্কহীনতা, অবিশ্বাস এবং পারিবারিক কাঠামোর ভাঙন। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণযোগ্য অ্যারিস্টটলের নৈতিক দর্শন, যেখানে পরিবারকে বিবেচনা করা হয়েছে ‘নৈতিক সমাজের প্রাথমিক ইউনিট’ হিসেবে। তাতে পরিবারকে মনে করা হয়েছে একটি এমন সামাজিক পরিসর, যেখানে পারস্পরিক দায়িত্ব, স্নেহ এবং নৈতিক বিকাশের সূচনা ঘটে। এই মূল ইউনিটেই যদি শত্রুতার বীজ বপন করা হয়, তবে বৃহত্তর সমাজে বিভাজন, অবিচার ও অমানবিকতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই সমাজে নর-নারীর সম্পর্ককে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নয়, সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে গড়ে তোলাই নতুন বাংলাদেশ গঠনের পূর্বশর্ত।

ছোট পরিসরে (মাইক্রো লেভেল) পারস্পরিক নির্ভরতা ও সম্পূরকতার প্রাথমিক এবং সবচেয়ে মৌলিক কেন্দ্রস্থল হলো পরিবার। এটি একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ইউনিট, যা গঠিত হয় নর ও নারীর সম্মিলিত অংশগ্রহণে। পরিবার কেবল একটি আত্মীয়তার কাঠামো নয়; এটি মানবসমাজের ভিত্তিপ্রস্তর, যেখানে নৈতিকতা, সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার বীজ রোপিত হয়। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্যই এটি হয়ে ওঠে মানবিক শিক্ষার প্রথম পাঠশালা। এখানেই শেখা হয় কিভাবে ভালোবাসতে হয়, ভিন্নমতকে সহনীয়ভাবে গ্রহণ করতে হয়, এবং ত্যাগ ও সহনশীলতার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের সৌন্দর্য রক্ষা করতে হয়। তাই দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘দ্যা রিপাবলিক’-এ যে ‘আদর্শ রাষ্ট্র’-এর স্বপ্ন দেখেছেন, তার মূল ভিত্তি সুসংগঠিত পরিবার। তাঁর মতে, পরিবার যদি ন্যায়ের চর্চা ও আত্মসংযমের শিক্ষা না দেয়, তবে রাষ্ট্রও ন্যায়ভিত্তিক হয়ে উঠতে পারে না। ঠিক তেমনি, যদি পরিবারের অভ্যন্তরে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও নৈতিকতা অনুপস্থিত থাকে, তবে বৃহত্তর সমাজে ঐক্য, সহযোগিতা ও মানবিকতা কেবল অলীক কল্পনা হয়েই থেকে যায়।

পরিবার তাই নিছক রক্তের সম্পর্ক নয়, এটি একটি নৈতিক ও মানবিক স্থিতির কেন্দ্র, যেখানে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত সত্তা এক নতুন মানবিক সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করে। এই কেন্দ্রিক বন্ধনই রাষ্ট্রের ভীতকে করে দৃঢ় এবং সামাজিক স্থিতিকে করে টেকসই। সুতরাং পরিবারে নর-নারীর সহযোগিতামূলক সম্পর্ককে জাগ্রত ও সুরক্ষিত রাখা, আগামী দিনের কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বিনির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমান সময়ে আমরা এক ক্রমবর্ধমান ও গভীর উদ্বেগজনক বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি যেখানে অসংখ্য শিশু পারিবারিক পরিসরে প্রতিনিয়ত বিবাদ, হিংসা, অবমাননা ও বঞ্চনার পরিবেশে বেড়ে উঠছে। এই পরিবেশ তাদের শৈশবের নিরাপত্তা ও নির্ভরতাবোধকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং তাদের মনোজাগতিক বিকাশে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে। মা-বাবার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব, ক্ষমাশীলতার সংকট ও স্বার্থপর সংঘর্ষ শিশুর মনে অবচেতনে রোপণ করে অবিশ্বাস, নিরাপত্তাহীনতা, পলায়নপরতা ও আত্মরক্ষার প্রবণতা যা পরবর্তীকালে তাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে ভালোবাসা, আস্থা ও মানসিক নিরাপত্তা অপরিহার্য দৈহিক পুষ্টির মতোই অপরিহার্য। এসব না পেলে, তারা ধীরে ধীরে রুক্ষতা, সংশয় ও ভেতরগত প্রতিহিংসার শিকার হয়। মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসনের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ তত্ত্ব অনুযায়ী, শিশুর আত্মপরিচয় ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণের ভিত্তি হলো প্রাথমিক বিশ্বাস (বেসিক ট্রাস্ট) যা প্রধানত পরিবার থেকেই জন্ম নেয়। যদি পরিবার এই বিশ্বাস ও নির্ভরতার অভিপ্রায় ভঙ্গ করে, তবে সেই শূন্যতা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কখনোই পূরণ করতে পারে না। এখানে প্রশ্ন ওঠে: তাহলে এই অবস্থা কে তৈরি করছে? এর দায় এককভাবে শিশুদের নয়, বরং আমাদের অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক সমাজের। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা, আত্মসংযম ও আত্মশাসনের অভাব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব পালনের প্রতি উদাসীনতাই এই নৈতিক সংকটকে উসকে দিয়েছে। তাই পারিবারিক সম্পর্কের অবক্ষয় নিছক ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয়, বরং এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর প্রজন্মগত নৈতিক বিপর্যয়ের অশনিসংকেত।

অপরদিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে নারীর প্রতি বিরূপ আচরণ, অন্যায় ও অবিচারও মানুষের পারিবারিক শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায় বিচারের অভাবেও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ। এখনই সময় পারস্পরিক বিভেদকে উসকে দেওয়ার প্রবণতা থেকে সরে এসে তা প্রশমনের পথ খোঁজার; এখনই প্রয়োজন শত্রুতা নয়, সম্প্রীতির ভিত্তিতে নর-নারীর সম্পর্ক পুনর্গঠনের। একে অপরকে বিপরীত বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়, বরং পারস্পরিক পরিপূরক ও সহযোগী সত্তা হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই একটি নতুন সামাজিক চেতনার জন্ম দিতে পারে। জীবনের দীর্ঘ, জটিল ও বহুমাত্রিক পথচলায় পুরুষ ও নারী পারস্পরিক সহযোগিতায় দুই সমান গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী বা অংশীদার হিসেবে একে অপরের পাশে থাকলে তবেই সম্ভব হবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সৌহার্দ্যময় ও সহনশীল সমাজ গঠন।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই মানবিক রূপান্তরের সূচনা হতে হবে আত্মিক জাগরণ দিয়ে, অর্থাৎ হৃদয়ের গভীরে যে পরিবর্তন আসে, তা-ই বৃহত্তর পরিবর্তনের ভিত্তি। রাশিয়ান সাহিত্যিক লেভ টলস্টয়ের সেই গভীর উপলব্ধি এখানে স্মরণীয় যে, ‘সব বড়ো পরিবর্তন শুরু হয় হৃদয়ের পরিবর্তন দিয়ে’। অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, এক্ষেত্রে বিশেষত নর-নারী সম্পর্ক বিষয়ে, আমাদের মনোবৃত্তির পরিবর্তন হচ্ছে আমাদের সমাজের নৈতিক পুনর্জাগরণের প্রধান শর্ত। সমাজ বিজ্ঞানের বহু তত্ত্ব বা গবেষণায়ও উঠে এসেছে, ব্যক্তির মনোভাবের মৌলিক রূপান্তর ছাড়া কোনো টেকসই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই রূপান্তরের মূলে থাকতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, বোঝাপড়া ও মানবপ্রেমের অবিচল আবহ এবং আস্থা। একমাত্র এই মানসিক কাঠামো থেকেই জন্ম নিতে পারে একটি সুসংগঠিত পরিবার, সংহত সমাজ এবং ন্যায়নির্ভর মানবিক রাষ্ট্র। আর তখনই আমরা এগিয়ে যেতে পারব একটি স্থিতিশীল, নৈতিক ও মূল্যবোধভিত্তিক ভবিষ্যতের দিকে যেখানে নর ও নারীর সম্মিলিত মানবিকবোধ, সহযোগতামূলক শ্রম ও শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় গড়ে উঠবে সত্যিকারের নতুন বাংলাদেশ।

নর-নারী সম্পর্ককে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চে দাঁড় করানো মানবসভ্যতার জন্য আত্মঘাতী এক প্রবণতা যা কেবল ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের শান্তিকে ব্যাহত করে না, বরং সমাজের নৈতিক ভিত্তি, প্রজন্মগত বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও চ্যালেঞ্জ করে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের জন্ম দেয়, অন্যদিকে তেমনি সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক কাঠামোর ওপর আঘাত হানে। অথচ প্রকৃতি নিজেই আমাদের শেখায় পরস্পর নির্ভরতা ও পরিপূরকতার মর্ম, যেখানে বিভিন্নতা মানেই বিভাজন নয়, বরং সৃজনশীল সমন্বয়ের সম্ভাবনা। পুরুষ ও নারীর পার্থক্য তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং একে অপরের শক্তি ও দুর্বলতা পূরণে সক্ষম দুটি পরিপূরক সত্তা হিসেবে গড়ে তোলে। সমাজে টেকসই উন্নয়ন ও সত্যিকার মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন নর-নারীর সম্পর্ক হবে সহযোগিতা, শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে গঠিত। সময় এসেছে এমন একটি সমাজচেতনা গড়ে তোলার, যেখানে নারী তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা, নিরাপত্তা ও সহযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন এবং পুরুষকে দেখা হবে একজন দায়িত্ববান, সহানুভূতিশীল ও নৈতিক সত্তা হিসেবে। এই চেতনার আলোকে গড়ে উঠতে পারে এক নতুন সমাজ, যেখানে লিঙ্গ নয়, বরং মানবিকতা হবে মর্যাদার মূল মানদণ্ড, আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা হবে সকল সম্পর্কের ভিত্তি।

‘নারী’ কবিতায় আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। নারীর প্রতি এমন শ্রদ্ধাশীল ইতিবাক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠা কেবল আইন বা নীতিমালার মাধ্যমে নয়, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং জনশিক্ষার মাধ্যমে জনচেতনার গভীরে পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের প্রয়োজন এমন এক মানবিক সমাজগঠনের আন্দোলন, যেখানে মানুষ আগে মানুষ, তারপরই নারী বা পুরুষ। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর ‘ন্যায়’ দর্শনের মতো করে বলতে গেলে, একটি সমাজ তখনই ন্যায়নিষ্ঠ হয়, যখন প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব ধর্ম ও ভূমিকা অনুযায়ী সম্মান পায়। সেই সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তি হবে মনুষ্যত্ব, সহানুভূতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা যা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে বিকশিত হতে পারে। এই মানবিক পথেই গড়ে উঠবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সহানুভূতিপূর্ণ, শোষণমুক্ত সমাজ যার কেন্দ্রবিন্দু হবে ভালোবাসা, বোঝাপড়া ও যৌথ উত্তরাধিকারের বোধ। সেই সমাজে নর ও নারী হবেন পরস্পরের আশ্রয়, পরিপূরক ও সহযাত্রী বা সহযোগী; কোনভাবেই একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।

লেখকঃ ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য। 

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৮/০৫/২০২৫

 


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading