নিজস্ব প্রতিবেদক।।নতুন বছর আসার উপলক্ষ উদযাপনে ঘড়ি ধরে সময়ের অপেক্ষার তর সইল না; রাত একটু বাড়তেই পাড়া মহল্লার চারপাশে শুরু হয়ে গেল হৈ চৈ, থেমে থেমে ভেসে আসতে থাকল পটকার শব্দ।
চারিদিকের শব্দ আর আনন্দ আয়োজন জানান দিতে থাকল নতুন বছরের আগমনী বার্তা।
ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁতে তখনও অনেক দেরি। কোথাও কোথাও রাত ১০টার পর থেকে কোথাওবা এরও আগে শুরু হয়েছে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এ আয়োজন।
এরপর সময়ের কাঁটা যত এগিয়েছে গলি, মহল্লার সড়ক আর বাসার ছাদে বাড়তে দেখা গেছে মানুষ। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে তারা পরিবারের সদস্য, বন্ধু, স্বজনদের নিয়ে উৎসবের আনন্দে মেতেছেন।
ঘড়িতে সময় ১২টা বাজতেই গল্প আর আড্ডার ফাঁকে ’হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন একে অপরকে। ওই সময় পটকা ও আতশবাজির সঙ্গে গানবাজনার শব্দে একাকার হয়ে গেছে পুরো নগরী। সমস্বরে উল্লাস ধ্বনিতে স্বাগত জানানো হয় নতুন বছরকে।
পৌষের রাতের নীরবতা ওই সময়ের আগে পরে খান খান হয়ে গেছে বিকট শব্দে। বাসা বাড়ির ঘরোয়া আয়োজন আর রেস্তোঁরার আনুষ্ঠানিক উদযাপনকে ছাপিয়ে চারপাশ হয়ে উঠেছে বর্ণিল।
আগের কয়েক বছরের মত এবারও উৎসব উদযাপনের আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে উবে গেছে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল। আতশবাজিতে রঙিন হয়ে উঠেছে রাতের আকাশ।
বিধি নিষেধের কড়াকড়ি ও বেড়াজালের মধ্যেই এভাবে নতুন খ্রিষ্টীয় বছর বরণে ঢাকাজুড়ে আতশবাজি পুড়ল, পটকার শব্দে প্রকম্পিত হল এলাকার পর এলাকা।
মিরপুর ১২ এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, সন্ধ্যার পর থেকেই তার এলাকায় আতশবাজি ফোটানো শুরু হয়। তবে রাত সাড়ে ১১টার পর এর তীব্রতা বাড়তে থাকে।
এসময় মানুষজন বিভিন্ন বাসার ছাদে উঠে এসে ফানুশ ও আতশবাজি ফুটিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে শুরু করে।
আইডিয়াল প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাহমিদ আদনান মিরপুরে বেড়াতে এসেছেন খালার বাসায়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি এখানে বেড়াতে আসছি তাই কিছু করিনি। বন্ধুবান্ধবের সাথে থাকলে ফুটাইতাম। কিন্তু এগুলো দেখে ভাল লাগতেছে।”
তবে উদযাপন ঘিরে তরুণ এবং বয়স্কদের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকলেও, ছোট শিশুদের বিকট শব্দে ভয়ে কেঁপে উঠার পাশাপাশি কাঁদতে দেখা গেছে।
দুই বছরের শিশু লাবণ্যের বাবা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “আমরা তো এগুলা দেখে আনন্দ করতেছি কিন্তু ও সন্ধ্যা থেকেই ভয় পাচ্ছে। অনেক শব্দ হচ্ছে তো হঠাৎ করে, নিতে পারছে না।”
পাল্টে যাওয়া টিএসসি
তবে ইংরেজি বর্ষবরণের রাতে সচরাচর দৃশ্যের চেয়ে এবারও ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গতবারের মত টিএসসি এলাকা অনেকটাই নীরব ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পটকা কিংবা আতশবাজিতে মাতেননি।
আর প্রবেশে কড়াকড়ির কারণে সেখানে বড় জমায়েত হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের অনেককে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশে ফটকগুলোতে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা থাকায় বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কগুলোতে শিক্ষার্থীরা দলে দলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কলা ভবনের সামনে, হাকিম চত্বরে এবং বিভিন্ন খালি জায়গায় দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যাডমিন্টন খেলছে। হল পাড়ায় শিক্ষার্থীরা জসিম উদ্দিন হলের খেলার মাঠে ক্রিকেট খেলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেখা গেছে।
এছাড়াও অন্যান্য বছরের মত এবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফানুস ও আতশবাজি হঠাৎ দেখা যায়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশপাশে এলাকা থেকে আতশবাজি ফাটানোর শব্দ শোনা গেছে।
তবুও পটকায় কাঁপল চারদিক
পুলিশ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা, অনুরোধ, প্রাণিপ্রেমী আর সংবেদনশীল মানুষের নানা প্রচারণা উপেক্ষা করেই বর্ষবরণের প্রথম প্রহরটা বিকট শব্দে পটকা-আতশবাজি ফুটিয়ে উদযাপন করল ঢাকার মানুষ।
পটকাবাজির সঙ্গে রাজধানীর আকাশে বাদ যায়নি ফানুস ওড়ানো। গতবারের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও দুর্ঘটনার পর এবারও শঙ্কা থেকে যা ওড়াতে নিষেধ করে আসছে মেট্রোরেল, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।
মধ্যরাতের কয়েকঘণ্টা আগেই ঢাকা শহরে বিচ্ছিন্নভাবে ফুটতে থাকে পটকা আর আতশবাজি। মধ্যরাতে পটকার শব্দে রীতিমত কেঁপে ওঠে জনবহুল রাজধানী ঢাকা।
রাজধানীর পূর্ব শ্যাওড়াপাড়া এলাকার অরবিটের গলি এলাকার বাসিন্দা ইমতিয়াজ আলম প্রাপন ফেইসবুকে লিখেছেন, ”রাত ৯টা ২২। এ মুহূর্তে পূর্ব শ্যাওড়াপাড়ার একটি মাইকে ঘোষণা চলছে, “আতশবাজির শব্দে একটি নবজাতক শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। এবং এখনও আতশবাজি ফুটছে। আহ্ জীবন কত সস্তা।”
পরে যোগাযোগ করা হলে ইমতিয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি বাসায় ফেরার সময় রিকশায় করে এমন ‘মাইকিং’ করতে শোনেন। তবে শিশুটি কোথায় মারা গিয়েছে তা তিনি নিশ্চিত নন। সম্প্রতি কোনো শিশু পটকার শব্দে মারা গিয়েছে না কি দুই বছর আগে বর্ষবরণের সময় পটকার শব্দে মারা যাওয়া শিশু উমায়েরের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে তাও ওই প্রচারণায় স্পষ্ট নয়, যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে মিরপুর থানার ওসি গিয়াসউদ্দীন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পটকার শব্দে নবজাতকের মৃত্যুর কোনো খবর তাদের জানা নেই। তিনি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান।
পটকা-আতশবাজির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কয়েকদিন আগেই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানায়। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে বারবার অনুরোধ করা হয়। তবে রাজধানীর পাড়া-মহল্লার পরিস্থিতি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন।
ঘড়ির কাঁটা ধরে নতুন বছর শুরু হয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টার পরও ক্রমাগত চলছে পটকা আর আতশবাজি। কোথাও কোথাও যেন পাল্লা দিয়ে ফোটানো হয়েছে এগুলো। কারও কারও জন্য তা উৎসবের আমেজ বয়ে আনলেও রাজধানীবাসীর অনেকের কাছে তা ছিল পীড়াদায়ক।
রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মো. শাকিল বলেন, পুলিশ পটকা-আতশবাজি নিষিদ্ধ করেছে অথচ তাদের মহল্লায় আরও দুদিন আগে থেকেই স্থানীয় মুদি দোকানগুলোতে এগুলো বিক্রি হচ্ছে। মহল্লার মোড়ে মোড়ে তরুণ-কিশোরেরা টেবিল নিয়ে বা মাদুর বিছিয়ে পটকার অস্থায়ী দোকান নিয়ে বসেছে।
পেশায় গাড়িচালক শাকিল বলেন, “আমার ১০ বছরের পোলায় খালি বাইরে যায় আর একটা কইরা ১০ টাকা দামের পটকা নিয়া আসে। আমি টাকা দিতে দিতে অস্থির। পাশের বাড়ির লোক কমপ্লিন দিতেছে, কিন্তু পোলাপাইনরে বুঝাইতে পারি না।”
রক্তাক্ত ক্ষত পেরিয়ে বর্ষবরণের উৎসব
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জ্বালাও পোড়াও ও সহিংসতার দিনগুলোতে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ পেরিয়ে গত অগাস্টে পালাবদল দেখেছে বাংলাদেশ। পরিবর্তনের এ পথচলায মানুষের দিন কেটেছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। আন্দোলনে থমকে থাকা ঢাকার রাজপথের ভোগান্তি, কখনো ডাকাত আতঙ্ক, রাজনীতির মাঠের নানা অস্থিরতার মধ্যেই নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছেন মানুষ।
বাড়িতে কিংবা পাড়া-মহল্লায় দল বেঁধে গান-বাজনা আর ভালো খাবারের আয়োজনে মানুষ ভুলে যেতে চেয়েছে পুরনো ক্ষতগুলোকে। নতুনকে বরণ করে নিয়েছে উদযাপনে।
বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ইশরাত সোহেলি বলছেন, ”আমার মত অনেকেই সেই জুলাই-অগাস্টের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তখন টানা কয়েকদিন মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসত। পত্রিকায় দেখতাম বাসায় থাকা বাচ্চারাও মারা যাচ্ছে। দরজা-জানলা আটকে কেটেছে কয়েকদিন। এই রাতে পটকাবাজির শব্দ অসহ্য মনে হচ্ছে। যদিও পাশের গলিতে ব্যপক গান-বাজনা হচ্ছে, তবে ভয় কাটছে না।”
আগের বছরের মত এবারও পটকা-আতশবাজি আর ফানুস ওড়ানোর নিষেধাজ্ঞা কাগুজে বলে প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকার আকাশ ছেয়েছে আতশবাজি আর ফানুসে। অলি-গলিতে বিকট শব্দে গান বাজিয়ে নতুনকে উদযাপন করেছে তরুণেরা।
শ্যামলী এলাকার ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী বলছেন, “আমাগের মহল্লায় বিকালবেলা থিকাই শুরু হইছে ধুমধাড়াক্কা গান। আশপাশের দোকানগুলান থিকা পয়সা তুলছে। তুইলা এইসব নাচা-গানা করতেছে।”
বিরক্ত সোলায়মান বলেন, “পোলাপাইনে ফেইসবুকে ইন্ডিয়ারে এত গাইলায়, দেখেন বাজাইতাছে কিন্তু সব হিন্দি আর পাঞ্জাবি ভাঙড়া গান।”
শিক্ষাবার্তা /এ/০১/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.