রাজেকুজ্জামান রতন।।স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এতটা ঘটনাবহুল বছর এর আগে দেখেনি বাংলাদেশের জনগণ। শুরু হয়েছিল ৭ জানুয়ারির নির্বাচন দিয়ে, শেষ হতে যাচ্ছে সচিবালয়ে আগুনের ঘটনার মাধ্যমে। মাঝখানে জুলাইয়ের আন্দোলন এবং ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা।
বছরের শুরুতে মনে হয়েছিল, এই ক্লান্তিকর বছর কি শেষ হবে? আর শেষে মনে হলো, আহা রে, আরও একটি বছর চলে গেল? এটা তো ঠিক যে, প্রতিটি বছরের দৈর্ঘ্য এক হলেও তার রাজনৈতিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এক রকম থাকে না। কোনো কোনো বছর ইতিহাসের গর্ভে বছর হারিয়ে গেলেও সে বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে বারবার।
২০২৪ সালকে সে রকমই একটি বছর হিসেবে দেখেছে বাংলাদেশের জনগণ। রাজনৈতিক আলোচনায় এবং আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় এ বছরের কথা ঘুরে আসবে বারবার। যেমন করে আইয়ুববিরোধী ৬৯-এর অভ্যুত্থান, এরশাদবিরোধী ৯০-এর অভ্যুত্থানের কথা রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণ করা হয়, তেমনিভাবে মানুষ মনে রাখবে ২৪-এর ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থানের কথা। জনগণের ক্ষোভের মুখে শাসকের পদত্যাগ ও পলায়নের কথা।
বিক্ষোভে আন্দোলনে এ শতাব্দীর এক-চতুর্থাংশ কেটে গেলেও ২০২৪ সাল সব দিক থেকেই অনন্য। উত্তেজনা আর অবসাদে কেটে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায় হতাশা নেমে এসেছিল। ক্ষমতাসীনদের আত্মবিশ্বাস আত্মম্ভরিতায় পরিণত হয়েছিল, বিরোধীদের প্রতিবাদ মিছিলগুলো বড় হচ্ছিল কিন্তু ফলাফল কী হবে, সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা যাবে কি? এই প্রশ্ন ঘুরে ঘুরে আসছিল বারবার।
আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল ২০০৯ সালে এবং ক্ষমতায় এসে এমন নির্বাচনী ব্যবস্থাই করেছিল যে. মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। এক অদ্ভুত দক্ষতায় নির্বাচনী ব্যবস্থায় নতুন নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করে নির্বাচনের ওপর থেকে জনগণের আস্থা আর বিরোধীদের আগ্রহ ধ্বংস করে দিয়েছিল তারা।
২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ প্রতিটি নির্বাচন একেকটি নির্বাচনী অপকৌশল হিসেবে চিহ্নিত। সারা দুনিয়ায় যারাই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে চাইবেন তারা এ ধরনের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলকে চাপের মধ্যে রাখে এটা দেখে মানুষ অভ্যস্ত। কিন্তু দমন-নিপীড়ন গুমের তীব্রতায় বিরোধী দলমত শুধু নিপীড়িত হয়েছে তাই নয়, সারা দেশে তৈরি হয়েছিল ভয়ের সংস্কৃতি। ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের শেষে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করতে গিয়ে গুলি খেয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, শ্রমিক ছাঁটাই, মামলা আর গ্রেপ্তারের পটভূমিতে।
বছরের শুরুতেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এবং সমস্ত বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচনকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার বৈধতা বলে আখ্যায়িত করা এক রাজনৈতিক নির্লজ্জতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেট জনজীবনকে দুর্দশার প্রান্তে নিয়ে এসেছে। এর শুরু যেমন আছে, তেমনি তীব্রতা বেড়েছে ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায়। চিনি, ভোজ্যতেল, জ¦ালানি তেল, খেজুর, রান্নার গ্যাসসহ যেসব আমদানিনির্ভর পণ্য সেগুলো তো আছেই এর সঙ্গে চাল, ডালসহ আংশিক আমদানিনির্ভর পণ্য এমনকি দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উচ্চমূল্যে কিনতে বাধ্য করা হয়েছে জনগণকে। সরকার ইউরোপের উদাহরণ দিয়ে দাম বৃদ্ধিকে যৌক্তিক করার চেষ্টা করেছে আর সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দিয়েছে। কৃষক পায়নি ন্যায্য দাম, শ্রমিক পায়নি ন্যায্য মজুরি, কিন্তু বাজারে পণ্য কিনেছে উচ্চমূল্যে। প্রতিবাদ বিবেচিত হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে।
দেশ থেকে ডলার পাচারের ঘটনা কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। ভাবা যায়! বাংলাদেশের মতো দেশ যার রপ্তানি আয় ৫৬ বিলিয়ন ডলার সেই দেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৭ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অর্থনীতি নিয়ে শে^তপত্র প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজার দর (১২০ টাকা) অনুযায়ী এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। প্রতি বছর জিডিপির ৩.৪ শতাংশ পরিমাণ টাকা পাচার হয়, যা রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ থেকে যত অর্থ আসে তার দ্বিগুণ অর্থ পাচার হয়। এই পাচারকে অর্থনীতিতে ক্যানসারের মতো আখ্যায়িত হয়েছে এই শ্বেতপত্রে। এতদিন যা ছিল ধারণা তা এখন হিসাব করে প্রকাশ করা তথ্যে পরিণত হয়েছে। এখন দরকার করণীয় নির্ধারণ। বড় বড় প্রকল্প, বড় বাজেট দেখানোর প্রবণতা একদিকে মানুষকে উন্নয়নের মোহে আচ্ছন্ন রাখা আর অন্যদিকে লুণ্ঠনের সুযোগ তৈরি হিসেবেই দেখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এত আকাক্সক্ষা এবং প্রচারণার কর্ণফুলী টানেল নাকি কোনো দিনই লাভের মুখ দেখবে না।
ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ডসহ কোনো দেশেই মেট্রোরেলের ভাড়া বাংলাদেশের মতো এত বেশি নয়, তা সত্ত্বেও মেট্রো একটি লোকসানি প্রকল্প। সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণ, হাওরের বুক চিরে রাস্তা নির্মাণ এসব কিছুর পেছনেই আছে অতিরিক্ত ব্যয়, দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। যার ফলে দেশ হারিয়েছে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আর জনগণের কাঁধে চেপে বসেছে ব্যয়ের বোঝা।
জনগণের আমানত হিসেবে ব্যাংক আর বিনিয়োগ হিসেবে শেয়ারবাজার লুট যেন শিল্পে পরিণত হয়েছিল। ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর মিলে ব্যাংক খালি করে ফেলার ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ এর আগে দেখেনি। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের ১৭ শতাংশ বর্তমানে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে টাকার অঙ্কে, যার পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। আর ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাতকে বলা হচ্ছে অর্থনীতির কৃষ্ণগহ্বর। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের কারণে ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ অর্জন, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
যারা বিগত সময়ে সরকার ঘনিষ্ঠ ছিল বলে যাদের সম্পর্কে কথা বলা দুঃসাধ্য ছিল তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু সংশয় তো থেকে যাচ্ছে, পাচারের টাকা কি দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে? সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আর বিপন্ন হয়েছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, অন্যদিকে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে রাখা দুটোই সমানতালে চলেছে।
দেশে থাকলে ভোট আর দেশ ছাড়লে জমি এই অমানবিক খেলা দেখেছে জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন নয়, শোষণমূলক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার সব রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে অতীত সময়ে। ২০২৪ সালের শুরুতেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল এক অভূতপূর্ব নির্বাচনী তামাশা।
একই দল দুই ভাগ হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, ঘোষণা দিয়ে ডামি প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রার্থী করা এবং আমি-ডামির নির্বাচন বহুদিন নির্বাচনী নোংরামির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই নির্বাচন একদিকে ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া লুণ্ঠন, দমন-পীড়ন বাড়িয়ে তুলেছিল তেমনি বিরোধী শিবিরে ক্ষুব্ধতা ও হতাশার এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতার কি আর অবসান হবে না?
পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয় বাহিনী, মামলা, হামলা দিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যে, জনমনে এই ধারণা স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। কিন্তু ভয় পাওয়া বা নিষ্ক্রিয়তা মানেই সব মেনে নেওয়া নয়। এলো জুলাই, মেনে নেওয়ার মানসিকতা আর ভীরুতাকে উড়িয়ে দিল রক্তের স্রোতে। আবু সাইদের বুক চিতিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, মুগ্ধর পানি খাওয়াতে গিয়ে রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া, বাবার কোলে রিয়া গোপের মৃত্যুর হাহাকার আর শাসকদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ঘটনা মানুষকে ভয় দেখায়নি বরং ভয় ভেঙে দিয়েছিল।
ফলে ৫ আগস্ট শুধু পদত্যাগ নয়, দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছে লাখ লাখ ছাত্র, শ্রমিক-জনতা। ২০২৪ সালের এই সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর সাফল্য রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বৈরাচারের পতন আর জনগণের বিজয়ের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বৈষম্যের বেদনা মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করেছিল। ছাত্র, শ্রমিক, নারী, শিশুর রক্তে এসেছে বিজয়। কিন্তু বিজয় হাতছাড়া হওয়ার বেদনাময় ইতিহাস আছে বাংলাদেশের জনগণের। জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনেছে, স্বৈরশাসককে উচ্ছেদ করেছে। অথচ পরবর্তীকালে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই সেই গণধিক্কৃত শক্তিকে বুকে টেনে নেওয়ার নজির দেখিয়েছে বারবার।
তাই অভ্যুত্থান সাফল্যের চার মাস পর বছরের শেষে এসে আবার প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, এই রক্তের সিঁড়ি বেয়ে গণতন্ত্র কি আসবে? কিছু বিতর্ক যেমন জাতীয় সংগীত, জাতীয় সীমানা, সংবিধান সংশোধন নয় পুনর্লিখন, সংস্কার না নির্বাচন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন ইত্যাদি উত্থাপন করায় রাজনীতিতে নানা ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়েছে। যে ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলনের তীব্রতা পেল, বিজয় অর্জিত হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার তৎপরতা, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা হেয় করে দেখা, ক্ষমতায় থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। জীবিকা ও মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন আর কৃষিপণ্যের দাম না পাওয়ার চিত্রের পরিবর্তন এখনো হয়নি।
২০২৪ দেখাল অনেক। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা শিখলেন কতটা? ক্রোধের তীব্রতায় উচ্ছেদ করা যায় সরকার, ভেঙেচুরে ফেলা যায় অবকাঠামো। কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত্তি নির্মাণ করতে সময় লাগে, লাগে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা। পুরনো শাসকের ভাষা ও দেহভঙ্গি যেন নতুনরা চর্চা না করে, মানুষ যেন বুঝতে পারে পরিবর্তন হয়েছে সেই লক্ষ্যে সরকার পরিচালনা করতে হবে, জনগণের প্রতি দায় নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে থাকতে হবে ক্ষমতায়। মানুষের সহজ চাওয়া, আগের মতো যেন না হয় সবকিছু। নতুন বছর যেন সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে, এই প্রত্যাশা জনগণের।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক
শিক্ষাবার্তা /এ/২৮/১২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.