এইমাত্র পাওয়া

জন্মসনদ পেতে ঘুষ ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক।। বছরখানেক আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল-৫-এর কার্যালয়ে ছেলের জন্মসনদ সংগ্রহ করেন যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মেহেদী হাসান। স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় সেটি নিয়ে যান তিনি। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, এই জন্মসনদ ভুয়া। একই রকম সমস্যার কথা জানিয়ে শারমিন সুলতানা নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে বাচ্চার জন্মনিবন্ধন করিয়েছি। বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির আবেদনে তা নেওয়া হচ্ছে না। নতুন করে আবেদন করতে বলা হয়েছে।’

ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের একরোখা সিদ্ধান্তের কারণে সনদ নিয়ে বিপদে পড়েছে ৮০ হাজার নাগরিক। নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়ে জন্মসনদের জন্য নতুন করে নিবন্ধন করতে হচ্ছে তাদের। মেয়র তাপসের সময় কেন্দ্রীয় সার্ভার উপেক্ষা করে নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করায় দেখা দিয়েছে জটিলতা। ডিএসসিসির সার্ভার থেকে নেওয়া জন্ম ও মৃত্যুসনদ কাজে লাগছে না। সিটির একজন কর্মকর্তা জানান, জাতীয় সার্ভার প্রায়ই ডাউন থাকত। তাই মেয়র এটা করেছিলেন। তবে মেয়র তাপস ও সরকারি অন্য দপ্তরের পরস্পরবিরোধী অবস্থানও এর জন্য দায়ী।

শুধু ডিএসসিসি নয়, জন্ম ও মৃত্যুসনদ পেতে সারা দেশে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তির যেন অন্ত নেই। মূলত জটিল নিয়ম এবং সার্ভার জটিলতার কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নিবন্ধন ও সংশোধনে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে ওয়ার্ড সচিব ও অফিস সহকারীরা কয়েকগুণ বাড়তি টাকা নিচ্ছেন। জন্মনিবন্ধন ও সংশোধনে সরকারি ফি ৫০ ও ১০০ টাকা হলেও সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে এক হাজার টাকা বা তার বেশিও নেওয়া হচ্ছে। সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, জন্ম-মৃত্যু ও নাগরিকত্ব সনদ পাওয়া এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, সেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে, যিনি ওয়ার্ডের লোকজনকে চেনেন না। এজন্য একটি জন্মসনদ নিতে ১০ দিনের বেশি লেগে যাচ্ছে।

সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে বাবা-মা জানতে পারছেন, তাদের নিবন্ধন করাতে হবে নিজের স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে। সন্তানের বাবা ও মা দুটি ভিন্ন জেলার বাসিন্দা হলে সেই বিড়ম্বনা আরও বেশি। ভুক্তভোগীরা প্রশ্ন তুলছেন, বর্তমান ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র করা গেলে জন্মনিবন্ধন কেন করা যাবে না। আর নিবন্ধনের আবেদনে স্থানীয় ঠিকানা তো আছেই। স্কুলে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ ১৯টি ক্ষেত্রে জন্মসনদ আবশ্যক। যে কারণে বছরজুড়ে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মসনদ নিতে ভিড় লেগে থাকে। পদ্ধতি নিয়ে ধারণার অভাব, প্রয়োজনীয় নথিপত্র জোগাড় করতে না পারাসহ নানা সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছেন জন্মসনদ করতে যাওয়া ব্যক্তিরা। ভোগান্তির আরেকটি দিক হলো, একবার জন্মনিবন্ধন করা হলেও সেটি অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন করে নিবন্ধন করাতে হচ্ছে। সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে বাবা-মায়ের জন্মসনদ তৈরি, সংশোধন করতে হচ্ছে।

এমনও দেখা যাচ্ছে, কারও বাংলায় সনদ থাকলেও ইংরেজিতে নেই। কারও আবার ইংরেজি থাকলে বাংলা করা নেই। নিবন্ধনকারী কর্মীদের ভুলে সংশোধন করতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে নাগরিকদের। সংশোধনে অনলাইনে আবেদনের একটি পদ্ধতি আছে। কিন্তু নানা জটিলতায় কাজ শেষ করতে পারে না ভুক্তভোগীরা। সব ভুল আবার তৃণমূল পর্যায়ে সংশোধন করা যায় না, ইউনিয়ন পরিষদের ভুল সংশোধন করতে আসতে হয় উপজেলায়। সেটিও এক দিনে বা এক সপ্তাহে হবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে সংশোধনের আবেদন বেড়েছে।

ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মমতাজ পারভীন তার দুই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবেন। জন্মসনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক কার্যালয় ঘুরেও করাতে পারেননি।

সম্প্রতি ডিএনসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে দেখা যায়, পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকার হালিম কমিউনিটি সেন্টারের চারতলায় সিটি করপোরেশনের সেবা নিতে প্রায় ৩০ জন অপেক্ষা করছেন। তাদের বেশিরভাগই জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত কাজে এসেছেন। জানতে চাইলে সেবাপ্রার্থীরা বলেন, টাকা ছাড়া কোনো সেবা দিচ্ছেন না ওয়ার্ড সচিব দ্বীন ইসলাম। তিনি জন্মনিবন্ধন নতুন কিংবা সংশোধনের জন্য ২০০ থেকে ২ হাজার করে টাকা নিচ্ছেন।  

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘চলতি বছর প্রায় ৩৯ লাখ জন্মনিবন্ধন সংশোধন আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। যারা সংশোধন করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নাগরিকেরা যেন সহজে সেবা পান, সে জন্য সিস্টেমের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। কাজে গতি এসেছে। সংশোধনের কাজ বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। জালিয়াতির অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

দক্ষিণ সিটির নাগরিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নাগরিকদের দোষ নেই। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে কাজটা করেছিল। আমরা তাদের বারবার বলেছি, তোমরা এটা বন্ধ করো। তখন করেনি। এখন অটোমেটিক্যালি তারা এসে পড়েছে। যেসব নাগরিক দক্ষিণ সিটির সার্ভারে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন, আমরা সেই ডাটাগুলো ট্রান্সফার করব।’

শিক্ষাবার্তা /এ/৩0/১১/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.