এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ।।   বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে রেটিংয়ে এক হাজারের মধ্যে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের নাম, সংবাদটি দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। স্কুলপর্যায় থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত লেখাপড়ার উল্লেখযোগ্য মানোন্নয়ন নেই। পাঠাভ্যাসে নেই শিক্ষার্থীর মনোযোগ। ক্লাসরুমে তাদের উপস্থিতি কমছে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদানে আগের মতো উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে না।

গণহারে চলছে প্রাইভেট পড়ানো। কোচিং সেন্টারগুলো দখল করে নিয়েছে শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলোর সঙ্গে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শিক্ষকতার মতো মহান পেশা আজ রূপ নিয়েছে এক লাভজনক বাণিজ্য হিসেবে। আগের দিন দেশে কোচিং সেন্টার বলতে তেমন কিছুই ছিল না। এমনকি গৃহশিক্ষক দিয়ে পড়ার ব্যবস্থাও ছিল একেবারে সীমিত।

বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে বসেই তাদের লেখাপড়া সেরে ফেলত। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক এমনভাবে পাঠদান করতেন যে, শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে খুব একটা পড়াশোনা করার প্রয়োজন পড়ত না। শিক্ষকরা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পড়া আদায় করে নিতেন। শ্রেণিকক্ষে পরীক্ষা হতো নিয়মিত। শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান দুর্দিনে অভিভাবকরা আজ হয়ে পড়েছেন জিম্মি।

শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে এসেছে নানারকম নৈরাজ্য, অনিয়ম আর অরাজকতা। একসময় দেশে শুরু হয়েছিল নকলের মহামারি। বর্তমানে নকল প্রবণতা কমে গেলেও শুরু হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জয়জয়কার। এ থেকে বাদ যাচ্ছে না দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষাও। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে মারামারি, হানাহানি, দখলবাণিজ্য। করছে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায়। শিক্ষকের মধ্যেও রয়েছে দলাদলি। তারা সরাসরি রাজনীতি করেন।

শিক্ষকদের দলে দলে বিভক্তি শিক্ষার্থীদের করে রেখেছে দ্বিধাবিভক্ত। শিক্ষাক্ষেত্রে পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। শিক্ষাঙ্গন থেকে সহশিক্ষা কার্যক্রম প্রায় উঠে গেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষাদান বিলুপ্তপ্রায়। বরং শিক্ষকদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভাব শিক্ষার্থীদের মননে বিস্তার লাভ করছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুপুরের পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ার কথা প্রকাশ পেয়েছে কোনো এক পর্যবেক্ষণে। এর কারণ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষের প্রতি অমনোযোগ এবং কোচিং সেন্টারমুখিতাকে দায়ী করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি নায়েমের উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বেসরকারি কলেজ শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় হতাশা প্রকাশ করা হয়।

দেশের মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিংহভাগই বেসরকারি কলেজ, যা গভর্নিং বডি দ্বারা পরিচালিত। অনেক ক্ষেত্রে গভর্নিং বডির কার্যকলাপের ওপর সরকারি পর্যায়ে তেমন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বেসরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর সত্যিকার যোগ্যতা ও মেধা সবসময় যাচাই করা হয় না।

অনেক ক্ষেত্রে কলেজের আয়-ব্যয় নিয়ে স্বচ্ছতারও প্রশ্ন তোলা হয়। এসব কারণে শিক্ষার পরিবেশও বিঘ্নিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। স্নাতক পরীক্ষায় পাসের শতকরা হার কমে যায়। পাবলিক পরীক্ষায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থীই উত্তীর্ণ হতে পারে না।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের পর অনেক শিক্ষার্থীর জীবনে আর কখনো স্নাতক ডিগ্রি লাভ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এসব সমস্যা উত্তরণে পেশকৃত সুপারিশের মধ্যে বেসরকারি কলেজ ব্যবস্থাপনার সার্বিক উন্নয়ন, কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

আজ শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী শিক্ষক এসেছেন। শিক্ষাঙ্গনের অবকাঠামোগত মানোন্নয়নও ঘটেছে যথেষ্ট। যুক্ত হয়েছে অনেক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা।

তারপরও শিক্ষায়তনে শিক্ষকদের নানারূপ সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা বিভাগের সামান্য কিছু অসাধু ব্যক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে অর্থ নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

এসবের ফলে বাধাগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। আজকালকার শিক্ষার্থীদের ভাষাজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে তারা ভালো ইংরেজি বা বাংলা বলতে বা লিখতে পারে না।

যার ফলে দেশে ও বিদেশে তারা চাকরি লাভে এবং কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। তাই যে কোনো বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা হোক না কেন, শুদ্ধ বাংলা ও ইংরেজি ভাষা বলা এবং লেখার দক্ষতা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অর্জন করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একজন শিক্ষক ন্যায়নিষ্ঠভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন, শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন, এটা তার নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষকের আদর্শেই গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীর আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে তার মা-বাবা, অভিভাবকদের দায়দায়িত্ব অপরিসীম। সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি তাদের যত্নশীল হতে হবে, দিতে হবে পর্যাপ্ত সময়। ঘরে বসে নিজের সাধ্যমতো লেখাপড়া শেখাতে হবে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান কতখানি হৃদয়ঙ্গম করতে পারল, তা যাচাই করতে হবে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মূলভিত্তি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর।

কর্মক্ষেত্রের দক্ষতার ভিত্তি তৈরি হয় এ স্তর পর্যন্ত। এ ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয় উচ্চশিক্ষার কাঠামো। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা স্তর অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে দেশে স্থির কোনো নীতিমালা আজও তৈরি হয়নি। বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে পরীক্ষার্থীদের একরকম গিনিপিগে পরিণত করা হচ্ছে।

দেশে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষার্থী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এর পরিবর্তন আনতে পরীক্ষার মূল্যায়নের তৎপরতার চেয়ে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজমান সব অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকের নিয়োগদানসহ কৃতী শিক্ষকদের ইনসেনটিভ দিতে হবে।

শিক্ষকদের দিতে হবে বিষয়ভিত্তিক উচ্চতর শিক্ষা ও উন্নত প্রশিক্ষণ। শিক্ষকদের দিয়ে ক্লাসে সঠিক পাঠদান প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিশ্চিত করতে হবে। অবসান ঘটাতে হবে কোচিং সেন্টারনির্ভর শিক্ষার। এসব দেখভালের জন্য কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করতে হবে।

থাকতে হবে উচ্চমানসম্পন্ন সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। শিক্ষার্থীদের পাঠাগারমুখী করতে ক্লাসের মাঝে বিরতি দিতে হবে। সেখানে পড়াশোনার নির্ধারিত সময় বরাদ্দ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব দেওয়া অত্যাবশ্যক। তাদের শরীরচর্চার জন্য খেলার মাঠ, অভ্যন্তরীণ এবং মাঠে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়নে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে এক সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে পারলে তা শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট নিরসনে সহায়তা করবে। সেই লক্ষ্যে শিক্ষক-অভিভাবক সংগঠন গড়ে তুলে নির্দিষ্ট বিরতিতে অভিভাবক শিক্ষকদের মধ্যে মতবিনিময়, শিক্ষাসংক্রান্ত সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর জন্য সর্বস্তরে উপযুক্ত বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

বিগত বছরগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ, মেধাবী জনশক্তি তৈরির চেয়ে পাসের হার বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলেছে। এর অবসান ঘটানো জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় গবেষণার বৃহত্তর পরিসর বৃদ্ধি করা দরকার। এর জন্য বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত হওয়া প্রয়োজন।

মেধাবী জাতি গঠনে দরকার শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন। সম্প্রতি চাকরিতে কোটা প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে। এর ফলে দেশে মেধার ভিত্তিতে চাকরি লাভের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আগামী দিনে এ ধরনের পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে সুবাতাস বয়ে আনবে। সমৃদ্ধ জাতি গঠনে দেশব্যাপী সুশিক্ষা বিস্তারের ধারা বেগবান হবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এ/২৮/১১/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.