বিপ্লব বড়ুয়া।।শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান এবং সর্বোপরি বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র মানুষের মৌলিক অধিকার। জনগণকে এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করা মানে মানবাধিকার হরণ করা। পৃথিবীর কমবেশি দেশে জনগণের এই মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষায় বিশেষ কঠোরতা আরোপ করে।
কিন্তু আমাদের মতো অনুন্নত দেশের জনগণ হয় চরম অবহেলিত উপেক্ষিত। মানবাধিকার যে একটি দেশের শ্রদ্ধা ও সম্মানের প্রতীক বিশ্বের অনেক দেশের সরকার তা মানতে চায় না। এ কারণে নানা অজুহাতে অধিকাংশ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান নিন্মতম সূচকে। আফগানিস্তান, পাকিস্তানও একই কাতারে। এইসব দেশে যখন যে সরকার আসে জনগণের নুন্যতম মৌলিক অধিকার ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
রাজনৈতিক শিষ্টতার অভাবের কারণে সাধারণ মানুষ জীবনে হাবুডুবু খায়। ভোগের সংস্কৃতির জয়জয়কার। দোষরোপের সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। যে যতবেশি লুটপাট করে তার বাহুবল হয় ততবেশি শক্ত। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এবং আগের যতগুলো সরকার দেশ পরিচালনা করেছে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশ পরিচালনা করেছে।
ত্যাগী মানুষের চেয়ে ভোগী মানুষের দল যখন ভারী হয়ে যায় তখন সাধারণ জনগণ একমাত্র প্রকৃতি ও ভাগ্যবিধাতার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কিছু বাকী থাকে না। তাই এমন এক সময় আসে জনগণই ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে বাধ্য হন। এর প্রমাণ আমরা আগেও দেখেছি সম্প্রতি আওয়ামী সরকার পতনের ক্ষেত্রেও তা দেখলাম।
একটি দেশকে উন্নতির শিখরে নিতে হলে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে তা-ই হয়ে থাকে। আমাদের দেশে উন্নত চিন্তার পরিবর্তে শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে ব্যবসাবান্ধব করা যায় সে নিয়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
আজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়ার নামে যা হচ্ছে তা একমাত্র শ্রেণি বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দেশের গুটিকয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেছে ব্যবসানির্ভর।
আগেকার সময় আমরা দেখেছি এলাকার দানশীল ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বিনামূল্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছে। আর এখন হচ্ছে তার উল্টো, যা একটি দেশ উন্নতির শিখরে যেতে প্রধান অন্তরায়। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিগত ৫৩ বছর শিক্ষাখাত ছিল চরম উপেক্ষিত। শিক্ষা সেক্টরে এই দৈন্যতা যেন শেষ হবার নয়!
শিক্ষায় এগিয়ে থাকলে মানুষের দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয়। নিজের জ্ঞানবুদ্ধি আর শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা ব্যতীত অন্যকিছুতে তা কখনও কল্পনা করা যায় না। এ দেশের মানুষ বরাবরই দেখেছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য সরকারের সহযোগী হয়েছে তাদের অধিকাংশজনের সন্তানরা দেশের বাইরে উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাগ্রহণ করে। সে কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার ব্যাপারে আমরা গাফিলতি লক্ষ্য করেছি যুগের পর যুগ ধরে।
আজ সেই ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা প্রচলিত নিয়মে ভর্তি হতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। প্রাথমিক সেক্টরে বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি প্রক্রিয়া হয়ে ওঠেছে পুরোপুরি ব্যবসা। ভর্তির নামে যা ইচ্ছে তাই হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়। জেলা-উপজেলায় ক্যাটাগরি ভাগ করে সরকার ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
আমি মনে করি এটি একটি শিক্ষাবান্ধব স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে সরকারের এ নির্দেশনকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভর্তি ফি আদায় করে। এরচেয়েও এখন শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একেক সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকরা প্রতিবছর দিশাহীন হয়ে পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
ইতোমধ্যে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির বিষয়ে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা ইচ্ছামাফিক ফরমের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। অথচ সরকার সামান্য অর্থ ভর্তুকি দিয়েই সকল শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় প্রাথমিক অংশগ্রহণের সুয়োগ করে দিতে পারে।
কিন্তু সেটি না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গলাকাটা দামে দেদারসে ফরম বিক্রি করছে। যার একেকটি আবেদন ফরমের মূল্য সর্বনিন্ম ৭’শ থেকে সর্বোচ্চ ১২’শ টাকা পর্যন্ত। আবার তার ওপর দিতে হয় ১০০/২০০ টাকা করে অনলাইন চার্জ।
শিক্ষা অর্জন সবার কাম্য কিন্তু দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর উর্দ্ধগতির কারণে অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। এ সংকটকালীন অবস্থায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেপরোয়া বৈপরীত্য পরিহার করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আড়ালে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে পিছিয়ে পড়ছে মধ্যম ও নিন্মআয়ের পরিবারের সন্তানেরা।
পারতপক্ষে কেউ চায় না শিক্ষা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে কিন্তু শিক্ষা সেক্টরের বৈষম্যনীতি এখন নীতিতে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের মতো অনুন্নয়নশীল দেশগুলোতে উচিত উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সামঞ্জস্য রেখে ঢেলে সাজানো। বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে যেভাবে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি হতো তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা।
সে ক্ষেত্রে অনেকটা ব্যয় সংকোচন হয় এবং ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরাও নিজ নিজ এলাকা থেকে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্ত এবার ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ বা সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্রভাবে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এতে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ যেমন বাড়বে তেমনি নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে অভিভাবকদের হাজার হাজার টাকা অপচয় হবে।
বিশাল একটি ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। যা অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। একজন শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার থেকে যদি খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল যেতে হয় তাহলে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে এই বিষয়টিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাথায় রাখা উচিত বলে মনে করি।
তাছাড়া একটি কঠিন নির্ঘুম জার্নিতো আছেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে অন্তত দেশের বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
সরকারের শিক্ষামহল ভর্তি প্রক্রিয়াকে আধুনিক যুগোপোযুগি করে গড়ে তোলা প্রয়োজন মনে করি। যদি এই প্রক্রিয়া সফল হয় তাহলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা তাদের আশা থেকে অন্তত বঞ্চিত হবে না। সেই সাথে শিক্ষার্থীরা ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবে এবং একই সাথে অভিভাবকরা অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবেন।
দেশে মেডিকেল কলেজ রয়েছে ১১০টি। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৬৭টি। এছাড়া একটি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ ও ৫টি বেসরকারি আর্মি মেডিকেল কলেজ। অধ্যয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মেডিকেলকে যেমন সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয় ঠিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়কেও একইভাবে প্রাধান্য দেয়।
যদি দেশের সব মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা একসাথে নেওয়া যায় তাহলে কেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষা নেওয়া যাবে না? বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েটের পাশাপাশি প্রাইভেট পাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা রয়েছে হাতেগোনা। এই অল্পসংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় ভর্তি পরীক্ষা নিতে নানারকম টালবাহানার অজুহাত দেখি। অথচ তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রকৌশলীরাই এগিয়ে থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকায়নে দিকনির্দেশনা দেওয়ার কথা। এক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে।
মেডিকেলের একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে দেশের শিক্ষার্থীদের দুঃশ্চিন্তা প্রশমিত করা জরুরি মনে করছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, কলাম লেখক
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এ/২৫/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.