চট্টগ্রামঃ পার্কের বাইরে তালা ঝুলছে। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে প্রবেশ ফটকের গেট। বিভিন্ন রাইড ও স্থাপনাগুলোও বন্ধ। ভেতরে থাকা ছোট কৃত্রিম হ্রদের পানিতে ভাসছে আবর্জনা। পার্কের যেসব স্থানে কংক্রিট নেই, সেখানে জন্মেছে লম্বা ঘাস ও আগাছা। নানা জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে চেয়ার-টেবিলগুলো। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থিত কর্ণফুলী শিশুপার্কের অবস্থা এখন বেহাল।
চট্টগ্রামে শিশু–কিশোরদের জন্য পার্ক ছিল মাত্র তিনটি। এর মধ্যে গত বছরের শেষের দিকে নগরের কাজীর দেউড়ির শিশুপার্কটি সিলগালা করে দেয় জেলা প্রশাসন। এরপর সেটি ভেঙে ফেলা হয়। এর ফলে আগ্রাবাদের কর্ণফুলী শিশুপার্ক ও চাদগাঁওয়ের স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পার্ক ছিল শিশুদের বিনোদনের স্থান। পার্ক দুটির প্রথমটি গণপূর্ত বিভাগের এবং অন্যটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন। গত ৫ আগস্ট থেকে এই দুই পার্কেও তালা ঝুলছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আত্মগোপন রয়েছেন পার্কের ইজারাদারেরা। ৫ আগস্ট লুটপাট চালানো হয় স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পার্কে। এরপর হামলার ভয়ে কর্ণফুলী পার্কে তালা দেয় কর্তৃপক্ষ। এ দুটি পার্ক দুই মাস ধরে বন্ধ। ফলে চট্টগ্রাম নগরে এখন শিশুদের আর কোনো বিনোদনকেন্দ্র নেই।
শিশুদের মানসিক বিকাশের উন্মুক্ত পরিবেশে ঘোরাঘুরি ও বিনোদনকেন্দ্রগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে নগরের শিশুদের ছুটির দিনে ঘুরে বেড়ানোর মতো পার্ক আর নেই। জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের হিসাবে, চট্টগ্রাম নগরে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। এর মধ্যে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখের বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি এক হাজার জন বাসিন্দাদের জন্য অন্তত তিন একর খেলার মাঠ কিংবা পার্ক প্রয়োজন। সে হিসাবে শিশুদের জন্য যে পরিমাণ মাঠ কিংবা পার্ক চট্টগ্রামে থাকার কথা, তার কিছুই নেই।
কর্ণফুলী শিশুপার্কের জন্য ১৯৯১ সালে ৯ একর জমি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে ইজারা দেওয়া হয়। এতে ২০০০ সালে পার্ক নির্মাণ করে আনন্দমেলা লিমিটেড। এর পর থেকে পার্কটির ব্যবস্থাপনায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৫ সালে শেষ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ইজারা চুক্তি।
সরেজমিন পার্ক দুটি ঘুরে দেখা গেছে বেহাল চিত্র। মূল ফটকে তালা দেওয়া থাকায় আগ্রাবাদের কর্ণফুলী শিশুপার্কের ভেতরে ঢোকা যায়নি। বাইরে থেকে দেখা যায়, ভেতরের খালি জায়গায় ঘাস-আগাছা জন্মেছে। বিভিন্ন স্থানে চেয়ার–টেবিল বিক্ষিপ্ত। পার্কের দুই নিরাপত্তাকর্মী আবদুল মালেক ও ইয়ার আলী জানান, ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান থেকেই পার্ক বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
পার্কের ব্যবস্থাপক হিসেবে জুয়েল নামের এক ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশন ও দুই নিরাপত্তাকর্মী। তাঁর মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পর ইজারাদার প্রকাশ্যে আসেননি। এ বিষয়ে এস্টেট শাখাকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
পার্কের মূল আকর্ষণ ছিল প্রায় ২০০ ফুট উঁচু টাওয়ারে থাকা ঘূর্ণমান রেস্তোরাঁ। ২৩ তলা উচ্চতায় অবস্থিত এই রেস্তোরাঁ থেকে এক নজরে পুরো চট্টগ্রাম শহর ও কর্ণফুলী নদী দেখার সুযোগ ছিল। ৫ ও ৬ আগস্ট পার্কের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে লোকজন ঢুকে পড়েন। এরপর পার্কের রেস্তোরাঁগুলোতে চলে লুটপাট। বিভিন্ন স্থাপনা থেকে খুলে নেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পার্কে লাইট, টাইলস, চেয়ার-টেবিল চুরি করা হয়। ভাঙচুর করা হয় টাওয়ারটিতেও।
জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে এটির ইজারা পেয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন। সরকার পতনের পর থেকে তিনিও আত্মগোপনে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পার্কের প্রবেশ ফটক খোলা। তবে সড়কের সঙ্গে থাকা মূল প্রবেশপথগুলো বন্ধ। কাঠ ও লোহার তার দিয়ে পেঁচিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গেট। দূর থেকে দেখা যায় টাওয়ারের কাচের দেয়ালগুলো ভাঙা। রেস্তোরাঁতেও ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পার্ক পরিদর্শন করেছেন। এটি চালুর জন্য একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এ ছাড়া কাজীর দেউড়ি পার্কের স্থানে শিশুবান্ধব কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
পার্কের পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরের শিশুদের জন্য উন্মুক্ত খোলামেলা পরিবেশেরও অভাব রয়েছে। নগরের বিপ্লব উদ্যান বাণিজ্যিক স্থাপনায় রূপ দেওয়া হচ্ছে। জাম্বুরি পার্কেও শিশুবান্ধব তেমন কিছু নেই। ফলে সেখানে কেবল হাঁটাচলার সুযোগ রয়েছে শিশুদের। যে কটি মাঠ চট্টগ্রামে আছে, সেখানেও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নগরে যে পরিমাণ খোলা জায়গা প্রয়োজন, তার ২৫ ভাগও নেই।
মাঠ ও পার্ক স্বল্পতায় অধিকাংশ অভিভাবকেরা শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন কিডস জোনের দিকে ঝুঁকছেন। এতে খরচের পাশাপাশি শিশুরা কেবল চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। তাদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তারা মুঠোফোনসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ‘আমরা ভেবে নিই যে একটা ফ্লাইওভার কিংবা একটা টানেল তৈরি করলে সেটা মনে হয় উন্নয়নের ইন্ডিকেটর (সূচক)। আমরা কিন্তু নতুন করে একটা সিআরবি তৈরি করতে পারিনি। সমস্যা হলো আমরা আসলে খেলার মাঠ কিংবা পার্ককে উন্নয়ন হিসেবে ধরি না। আমরা ভাবি, এটা লস প্রজেক্ট। এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৭/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.