ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম মুছে ফেলা মাউশির ডিডি আজিজ এখনও বহাল

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্কুল জীবনে পড়াশোনা করা চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ডায়েরি থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকারের অত্যন্ত আস্তাভাজন ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কর্তৃক পদায়ন করা প্রশ্ন ফাঁস, দুর্নীতি, বদলি বাণিজ্যসহ নানা বিতর্কে জড়ানো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন এখনও মাউশিতে স্বপদে বহাল তবিয়তে রয়েছে। 

শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার জন্য যৌথভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ও তিনি ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করলে ঠিক এরপর থেকে প্রতিবছর চট্টগ্রাম কলেজিয়াট স্কুলের শিক্ষার্থীদের ডায়েরির প্রচ্ছদে ‘২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর স্মৃতি ধন্য স্কুল’ লেখা হতো। সর্বশেষ ২০২২ সালের ডায়েরির প্রচ্ছদেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর স্মৃতি ধন্য স্কুল লেখা থাকলেও মাউশির উপ-পরিচালক আজিজের নির্দেশে ২০২৩ সালের ডায়েরি থেকে তা মুছে ফেলা হয়।পতিত শেখ হাসিনার সরকারের ২০২২ সালে  দেওয়া একের পর এক মামলায় যখন ড. ইউনূসকে জড়ানো হয় ঠিক সেই সময়ই মাউশির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থীদের ডায়েরি থেকে নাম মুছে ফেলার জন্য নির্দেশ দেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে প্রায় ১১ বছর ধরে প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন আজিজ উদ্দিন। এরপর টানা সাত বছর ছিলেন মাউশির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক পদে। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক থেকে অদ্যাবধি মাউশির মাধ্যমিকের উপ-পরিচালকের দায়িত্বে থাকায় চট্টগ্রামের সরকারি স্কুল গুলোতে তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। 

জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বাংলায় ২য় শ্রেণিতে বিএ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২য় শ্রেণিতে এমএ পাস করে ১৯৯১ সালে সহকারি শিক্ষক পদে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর ২০০১ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে পদায়ন পেয়ে ২০১১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। এই স্কুলেই কর্মরত থাকা অবস্থায় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের একান্ত সংস্পর্শে আসেন আজিজ।  শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে বাবা বলে সম্বোধন করে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন এবং নুরুল ইসলাম নাহিদকে দিয়ে ২০১১ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক পদে পদায়ন বাগিয়ে নেন। ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা সাত বছর এই পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। উপ-পরিচালক থাকাকালে এহেন কোন অনিয়ম নেই তা তিনি করেননি। এরপর ২০১৯ সালে ‘প্রিয় ধর্ম বাবা’ নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে আবদার করে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর মাউশির মাধ্যমিকের উপ-পরিচালক পদে পদায়ন বাগিয়ে নেন। চট্টগ্রামে নানা কেলেংকারী ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে লিয়েনে ৫ বছরের (১ মে ২০১৯-৩০ এপ্রিল ২০২৪) জন্য তাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হয়। এত দিন লিয়েনে বিদেশ থাকার অনুমতি নজীরবিহীন বলে জানান শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এরপর বিদেশ থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে আসলে তাকে মাউশিতে আবার একই পদে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সত্যিই বিস্ময়কর। মাউশির সাবেক মহাপরিচালক গোলাম ফারুখকে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে এই পদে ফিরে আসেন তিনি। 

আরও পড়ুনঃ

মাউশিতে আজিজের ভয়ংকর সিন্ডিকেট

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি, পাঠদানের অনুমতি, পদোন্নতি, বিল, ভাউচার উত্তোলন, পদায়ন বাণিজ্য, তদন্তের নামে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কাজে অনিয়মের মাধ্যমে ঘুষ বাণিজ্য থেকে এহেন কোন অপকর্ম নেই যা করেননি এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা ছিল শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের শিক্ষা কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর হালদার, শিক্ষা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম, মাউশির মাধ্যমিকের সহকা্রি পরচিলাক দূর্গা নারী সিগদার এবং প্রধান শিক্ষক পদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। এর মধ্যে চন্দ্র শেখর বর্তমানে কারাগারে, গত মাসের ২৯ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামকে বরগুনা সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে। তবে আজিজ এবং দুর্গা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। জানা গেছে, মাস্টারমাইন্ড আজিজ তার সিন্ডেকেটের সদস্য ডিবির হাতে আটক হয়ে কারাগারে থাকা সাবেক ছাত্রলীগের নেতা  চন্দ্র শেখর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ তরিকুল ইসলাম এবং আজিজের আগে থেকেই মাউশির সহকারী পরিচালকের দায়িত্বে থাকা দুর্গা রানী সিকদারের সহায়তায় নিয়মবহির্ভূতভাবে ঘুষের মহোৎসবে লিপ্ত হন। প্রশ্নফাঁস, এমপিও বাণিজ্য, বদলি, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদায়নে মোটা অংকের অর্থ নেওয়া, টাকা নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পক্ষে-বিপক্ষে দেওয়া, সেসিপের অর্থ আত্মসাৎ সহ কয়েক শত কোটি টাকার দুর্নীতি করে এই সিন্ডিকেট। সেসিপের ১৮৫ কোটি টাকা লোপাটের সাথে জড়িত মাউশির সাবেক ডিজি গোলাম ফারুখ, সেসিপের উপ-পরিচালক প্রফেসর ড. সামসুন নাহার সামনে আসলেও এই কাজের অন্যতম হোতা  আব্দুল আজিজ ধরাছোঁয়ার  বাইরে থেকে যায়। এই সিন্ডেকেটের প্রফেসর ড. সামসুন নাহার অদৃশ্য কারণে এখনও মাউশিতে বহাল রয়েছেন। 

এছাড়া ঢাকা মহানগরির স্কুলের ভর্তি কমিটির সদস্য সচিব আজিজ। টেলিটকের মাধ্যমে ভর্তির জন্য আসা টাকার ৫০ শতাংশ আসে তার একাউন্টে। এই টাকা প্রধান শিক্ষকদের কাছে বন্টন করার কথা থাকলেও আজিজ তা না করিয়ে পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করেন। 

১৩ মে  ২০২২ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার মুল মাস্টারমাইন্ড হলেও আড়ালে থাকেন আজিজ। এ ঘটনায় ধরা পরে মাউশির শিক্ষা কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর হালদার। ডিবি কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে  চন্দ্র শেখর হালদারের ব্যাংক একাউন্টে ৫০ কোটি টাকা পাওয়া যায়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়। ডিডি আজিজ উদ্দিনকে ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ তার কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন। আজিজের একাউন্টে মেলে কোটি কোটি টাকা। তবে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন আজিজ  বিভিন্ন কায়দায় ডিবি হারুনকে এক কোটি টাকা দিয়ে ছাড়া পান। চার্জশীটে তার নামও উঠে না। 

শত কোটি টাকার সম্পদ আজিজের 

মুল পদ একজন প্রধান শিক্ষক, চলা ফেরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তের মহাপরিচালকের চেয়েও দাপুটে। ৪র্থ গ্রেডের এই কর্মকর্তা এই পদে থেকে যত ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম করা যায় তা করে গড়েছেন শত কোটি টাকার সম্পদ। তবে সেটা দেশে নয় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। স্ত্রী সন্তান অষ্ট্রেলিয়ায় থাকেন। যখন বড় কোন অর্থ পাচার করতে হয় তখনই তিনি ছুটে যান অস্ট্রেলিয়ায়। মাউশি সূত্র বলছে,  ২০১৬ সালে ৫৯দিনের ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যান, ২০১৭ সালে ৩৩ দিনের ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পারি জমান, একই ভাবে ২০১৮ সালে প্রথমে  ৩১ দিন পরে ৪৪ দিন, ২০১৯ সালে ৩৯ দিন, ২০২২ সালে ৫৯ দিন লিয়েনে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা স্ত্রী খুরশীদা খানমের কাছে যান তিনি। তবে দুর্নীতির মোটা অংকের টাকা যতবার তাঁর হাতে একত্রিত হয়েছে ততবার তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পারি জমিয়েছেন তা পাচারের উদ্দেশে। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে  চাইলে ডিডি আজিজের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিন তা ধরেন না। 

এবিষয়ে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য জোটের সমন্বয়ক মোঃ জাকির হোসেন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের দিয়ে বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না। এসব কর্মকর্তারা শিক্ষা ভবনকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। অবিলম্বে তাদের অপসরাণ করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আশ্চর্যজনক বিষয় শেখ হাসিনার সরকারের আমলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনও কিভাবে বলা থাকেন সেটা ভেবে অবাক হই। 

এ বিষয়ে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়ের কে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ব্যস্ত থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। 

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/৩১/১০/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.