নিজস্ব প্রতিবেদক, কুড়িগ্রাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের ছাত্রদলর ক্যাডার বাহিনীর তুষার নামে পরিচিত বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম। ছাত্রদলের তুখোর নেতা বর্তমান কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভির ছিলেন ছায়া সঙ্গী। রং বদলীয়ে এখন হয়েছেন আওয়ামী লীগ। নেতাদের তোষামোদি করে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসে বহাল আছেন দীর্ঘ ৯ বছর। নিজ জেলার অধিবাসী হওয়ায় ঘুষ দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতায় মানুষ অতিষ্ট হলেও তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায়না কেউ। চতুর শামছুল আলম দুর্নীতির সাম্রাজ্য চালাতে গড়ে তুলেছেন একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মুল হোতা ফ,ম ও ল আদ্যাক্ষরের তিন শিক্ষক নেতা। তাদের মাধ্যমে চলে লেনদেন এবং সকল অপকর্ম। একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করেও ভুক্তভোগীরা সুফল পায়নি কারণ শামছুল আলমের টাকার নেটওয়ার্ক অনেক শক্ত।
অনুসন্ধান ও অভিযোগে সূত্রে জানা গেছে, জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্যে করে গত ৯ বছরে কম পক্ষে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া ও বিভিন্ন অজুহাতে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের নিকট নানা অযুহাতে উৎকোচ ও উপহাড় গ্রহণ করেন। এছাড়া স্বজনপ্রীতি ও স্বোচ্ছাচারিতার কারণে জেলায় শিক্ষার মান বৃদ্ধি না পেলেও বেড়েছে শিক্ষা অফিসারের অবৈধ অর্থের পরিমান। আর এ অবৈধ অর্থ সাদা করতেই গ্রামের বাড়িতে পুকুর দিয়ে মাছ চাষ, কবুতর ও উন্নত জাতের রামছাগল পালন, দেশী বিদেশী ফল চাষ, ছেলেকে দিয়ে ব্যবসা এবং কৃষি জমি ক্রয় করে চাষাবাস। এসব প্রজেক্টে ইতোমধ্যে লগ্নি করেছেন কয়েক কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে মাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে ডিজির প্রতিনিধি দেয়া, শাখা খোলা ও এমপিও সংক্রান্ত কাজে শিক্ষকদের কাছে ঘুষ নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপির রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়ায় বিএনপির সময় ১৯৯৪ সালে চাকুরিতে যোগদান করেন। এরপর মাঝে বিরতীর পর বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসলে তদবীর করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব এবং পরবর্তীতে ২০০৫ সালে রংপুর ডিডি অফিসে ইন্সপেক্টর হিসাবে যোগদান এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে ডিডি’র চার্জ গ্রহন করেন। কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও চতুর এ কর্মকর্তা দলীয় রং পাল্টিয়ে নেতাদের তোষামোদ করে সরকার দলের তকমা লাগান। কুড়িগ্রামে ০৬/১১/২০১০ থেকে ২৩/০৩/২০১৪ পর্যন্ত ৩ বছর ৫ মাস জেলা শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। নানা অনিয়মের অভিযোগে শাস্তিমুলক বদলী করে দীর্ঘদিন রংপুর ও ঢাকা অফিসে সংযুক্ত করে রাখা হয়। তদবীর আর টাকার জোড়ে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার হিসাবে পদায়ন করা হয় ০৬/১০/২০১৮ সালে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর ৮ মাস টানা একই কর্মস্থলে। অর্থাৎ দু’ দফায় কুড়িগ্রামে ৯ বছরের বেশী সময় ধরে কর্মরত আছেন। বদলীর ফাইল উঠলেই তার টাকার তদবীরে তা থেমে যায়।
এতেই থেমে নেই তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহন। শুধু তাই নয় তিনি নিয়ম বহির্ভুতভাবে জেলার স্কাউট এর কমিশনারের পদটি দখল করে রেখেছেন। কমিটির সকল পদে তার মনোনিত সিন্ডিকেট সদস্যদের নির্বাচিত করতে কাউন্সিলর শিক্ষকদের বাধ্য করেন। ফলে কুড়িগ্রাম জেলার স্কাউটস এর গ্রুপিং এখন তুঙ্গে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলমের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার চর খুনিয়ার চর এলাকার বকবান্ধা নামাপাড়া গ্রামে। তিনি নিজ জেলায় চাকুরি করার সুবাদে প্রতিনিয়ত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে বৃহস্পতিবার বাড়িতে যান এবং রবিবার এসে অফিস করার কথা থাকলেও মাঝে মাঝে তাকে অনুপস্থিত থাকতে দেখা যায়। ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত দুই উপজেলা রৌমারী ও রাজিবপুরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের অজুহাতে তিনি রবিবারের এমনকি সোমবারও তার কুড়িগ্রামের অফিসে আসেন না।এনিয়ে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান গুলেঅতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে নানা গুঞ্জন ও ক্ষোভ। কেননা অনেক শিক্ষক দুর দুরান্ত থেকে এসে তাকে না পেয়ে ফিরে যেতে হয়।
বকবান্ধা নামাপাড়া গ্রামে রাস্তার ধারে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫৫ শতক জমি ক্রয় করেন। এখানে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন বাড়ি ও খামার বাড়ি এবং সৌন্দর্য বর্ধনের নানা স্থাপনা। চলতি বছর সায়দাবাদ বাজারে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বড় ছেলেকে দিয়ে চালু করেন ‘এস আর ব্রান্ড শপ’। এছাড়া গ্রামের বাড়িতে রয়েছে কয়েক একর আবাদী জমি। রংপুরে বাড়ি এবং ঢাকায় ফ্লাট বাড়ি। আয় বহির্ভুত এতো সম্পদ কি ভাবে হলো এমন প্রশ্ন এখন সবার।
ইতোপুর্বে তিনি ২০১৬ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা থাকাকালেও তার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে মাউশির প্রতিনিধি দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে।
বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বকসী ঠান্ডা জানান,একজন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিজের জেলায় দীর্ঘদিন থাকা দৃষ্টিকটু ব্যাপার। আর তার বিরুদ্ধে যে সব অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা উর্ধ্বতন কতর্ৃপক্ষ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারেন।
এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ ও জেলা দুনর্ীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ জানান, একজন শিক্ষা কর্মকর্তা দীর্ঘদিন এক অফিসে চাকুরি করলে তার পরিধি বিস্তৃত হয়। ফলে যেকোন অনিয়ন ও দুনর্ীীত করা সহজতর হয়। তার উপর এ কর্মকর্তা নিজ জেলায় ৯ বছর ধরে চাকুরি করায় দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার স্বেচ্ছাচারিতা, অসৌজন্য আচরণ, শিক্ষদের মধ্যে গ্রুপিং ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা সহ নানা কারণে জেলার শিক্ষার মান উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
রৌমারীর যাদুর চর ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম জানান, জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলমের পিতা ৮০দশকে তার পরিবার রংপুরে চলে যায়। গত ১০ বছরে তিনি এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। রাস্তার পাশে ১৫৫ শতক জমি কিনেন প্রায় কোটি টাকায়। এখন সেখানে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি, দুর্লভ ফলের বাগন, পুকুরে মাছ চাষ, ছাগল ও কবুতর লালন পালন, পানির ফোয়ারা তৈরী করেছেন। সায়দাবাদ বাজারে বড় ছেলেকে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছেন কোটি টাকা ব্যয়ে। এছাড়া রয়েছে কোটি টাকা মুল্যের কৃষি জমি। রংপুর শহরে বাড়ি এবং ঢাকায় রয়েছে ফ্লাট বাড়ি। চলে দান দক্ষিণা সহ প্রচারণার নানা কাজ। হঠাৎ তার ফুলেফেপে ওঠার ঘটনায় এলাকায় রয়েছে নানা গুঞ্জন।
সরকার বদল হলে ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। ছাত্র জীবনে তিনি ছিলেন ছাত্র দলের ক্যাডার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বর্তমান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা রিজভী আহমেদের সংস্পর্শে এসে গড়ে তোলেন তুষার বাহিনী। চাকুরীও শুরু করেন বিএনপির আমলে। বিএনপি’র নেতার হাত ধরে জেলা শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব বাগিয়ে নেন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে অল্প সময়ের মধ্যে রং পাল্টিয়ে নেতাদের তোষামোদি শুরু করে স্বার্থ সিদ্ধি করেন।কিন্ত তার চাচা আশরাফুল ইসলাম যাদুর চর ইউনিয়ন কৃষকদলের সভাপতি। তার সকল আত্নিয় স্বজন সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাই তিনি বাড়িতে এলে স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের হয়ে কাজ করেন। আর শহরে গেলে হয়ে যান আওয়ামী লীগ। এলাকায় জনশ্রুতি আছে বর্তমান সরকার পরিবর্তন হলে তিনি এলাকায় জাতীয়তাবাদি দলের হয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিবেন। এ লক্ষ্যে এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত ও জনসংযোগ করে যাচ্ছেন।
একই এলাকার জিয়াউর রহমান ও খোকা মিয়া জানান, শামছুল আলম তার নিজ স্বার্থে বকবান্ধা গ্রামকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। তারবিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও কেউ মুখফুটে কথা বলার সাহস পায়না। তার রাজনৈতিক দর্শন সরকার বিরোধী হলেও আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের সাথে সখ্যতা অনেক গভির। কয়েক বছর আগে ভাস্তি জামাইকে প্রধান শিক্ষক করে বকবান্ধা নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিক্ষার্থী না থাকলও ৮জন শিক্ষক নিয়োগে কোটি টাকা উৎকোচের অভিযোগ রয়েছে।
জেলা প্রবীন হিতৈষী সংঘের সভাপতি এবং স্কাউট ব্যক্তিত্ব একেএম সামিউল হক নান্টু বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ শুনেছি। সত্যতা তদন্ত করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। তবে তিনি স্কাউটের দায়িত্ব নিয়ে গ্রুপিং করে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মজনুর রহমান বলেন, জেলা শিক্ষা অফিসার দুর্নীতিবাজ। টাকা ছাড়া কোন কাজ করেন না। তার দুর্নীতির সিন্ডিকেটের হোতা ফারুক,মালেক, লতিফসহ ৫/৬জন। শামছুল আলম আমার কাছ থেকে নেফার দরগা উচ্চ বিদ্যালয়ের ডিজির প্রতিনিধি নেয়ার সময় উৎকোচের বাহানায় অভিযোগে একমাস টালবাহানা করেন।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমার বাবা ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। চাচা বিএনপি করে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আর আমার নাম তুষার নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধুর নাম তুষার ছিলো। আমার বাড়ি কুড়িগ্রামে এটা সত্য। আমার সুনাম ধ্বংস করবার জন্য একটি চক্র ষড়যন্ত্র করছে। আমি খুব শীঘ্রই বদলী হয়ে চলে যাবো দয়া করে অসম্মান করিয়েন না।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০২/০৬/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.