নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ নাজমুন নাহার। মূলপদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক। বর্তমানে চলতি দায়িত্বের সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ঢাকা আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক। তিনি আয়নাঘরের (গুম হত্যা, নির্যাতন ও মুঠোফোনের আড়িপাতা) মুলহোতা ও জনক মেজর জেনারেল (চাকুরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান ও আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ের ঢাকা ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে (প্রায় আট বছর চেয়ারম্যান ছিলেন যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ সময়) সাবেক চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক ও আওয়ামী লীগের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র জিয়াউর রহমান বিপ্লবের বোন। তিন ভাইয়ের ক্ষমতার দাপটে চাকরিজীবনের ৩২ বছরের ৩০ বছরই ঢাকা শহরে কর্মরত রয়েছেন। পতিত হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও ক্ষমতার দাপট কমেনি নাজমুন নাহারের। বর্তমানে ডিডি অফিসকে ঘুসের রাজ্যে পরিণত করেছেন তিনি। অভিযোগ পেলেই তদন্তে চলে যান তিনি। টাকা দিলে তদন্তে ‘পজেটিভ’ রিপোর্ট না দিলে ‘নেগিটিভ’ রিপোর্ট দেন তিনি। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না মাউশির ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের কোন কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই যুগের বেশি রাজধানীর মোহম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত থেকে চলতি বছরের মে মাসে চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষক হয়ে ভাইয়েদের ক্ষমতার প্রভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার আঞ্চলিক কার্যালয়ে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে পদায়ন বাগিয়ে নেন তিনি। গত ১৬ মে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আঞ্চলিক অফিসে যোগদান করেন।
অতি সম্প্রতি রাজধানীর একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্তের দায়িত্ব নেন নাজমুন নাহার। পদাধিকার বলে নাজমুন নাহার সহকারী শিক্ষক ও চলতি দায়িত্বের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদধারী হলেও একজন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্তে নামেন তিনি। নিয়মানুযায়ী, নিন্ম স্তরের কর্মকর্তা দিয়ে উচ্চ স্তরের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করার কোন সুযোগ না থাকলেও নামজমুন নাহার ঐ স্কুলটির সহকারী প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অসাদাচারন করেন এবং তদন্তে কোন ধরণের সহযোগিতা করেননি। তদন্তে পজিটিভ রিপোর্ট নিতে চাইলে মোটা অংকের ঘুস দাবি করেন তিনি। এ নিয়ে মাউশির মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ঐ প্রধান শিক্ষক। উল্লেখ্য যে, নিরাপত্তার স্বার্থে ঐ স্কুল ও প্রধান শিক্ষকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
লিখিত অভিযোগে প্রধান শিক্ষক উল্লেখ করেন, ‘বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমাকে হয়রানী করা এবং পদ দখলের ষড়যন্ত্র করছেন। আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের তদন্ত করার জন্য উপপরিচালক এর দপ্তরের নাজমুন্নাহারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই নাজমুন নাহার হচ্ছে একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক । আমি একজন প্রধান শিক্ষক সেই হিসাবে তিনি আমার তদন্ত করতে পারেন না। এছাড়াও তিনি সার্বক্ষনিকভাবে আমাকে হেনস্থা এবং বিভিন্নভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন। তিনি আমার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করছেন। তিনি বলছেন, আমি যদি টাকা না দেই তাহলে আমার বিরুদ্ধে নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়ে দিবেন। তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এখানে পোস্টিং নিয়েছেন এবং এই ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অফিসটাকে নিজের করে নিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য নাজমুন নাহারের আপন ভাই সাবেক ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান।’
শুধু এই একটি স্কুলের অভিযোগই নয় এরকম আরও অন্তত চার টি স্কুলের তদন্তে তিনি টাকা দাবি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আঞ্চলিক ডিডি অফিসে নামমুন নাহারের দায়িত্ব অভিযোগ প্রতিকারে ব্যবস্থা, জেলা শিক্ষা অফিসার, প্রধান শিক্ষকগণের ভ্রমণ বিল অনুমোদন, অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা, শিক্ষক, কর্মচারীদের পাসপোর্ট করার অনুমতি, গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন খেলাধুলার আয়োজন, নৈমিত্তিক ছুটি ব্যতীত বিভিন্ন প্রকার ছুটি সংক্রান্ত আবেদন নিষ্পত্তি, বদলীজনিত কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তান ভর্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ন ব্য্যন সংক্রান্ত এবং সকল ধরনের আইনগত বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ফাইল উঠানো এবং সেগুলো যাচাই বাছাই করে উপ-পরিচালকের কাছে প্রেরণ করা। কিন্তু নাজমুন নাহার টাকা ছাড়া এই ফাইল ছাড়েন না। টাকা পেলে দ্রুত ফাইল নামে মাত্র যাচাই করেই ডিডির নিকট প্রেরণ করেন। আর যারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান তাদের ফাইলে কোন ধরণের ত্রুটি না থাকলেও তা আটকে রাখেন। তার ক্ষমতার দাপটে বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননা। ফলে টাকা দিয়েই ফাইল উঠাতে হয়।
শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ সালে এসএসসি, সরকারি বরিশাল কলেজ থেকে ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাস, ১৯৮৯ সালে সরকারি মহিলা কলেজ, বরিশাল থেকে ডিগ্রী পাস করেন নাজমুন নাহার। এরপর ১৯৯২ সালের সহকারী শিক্ষক পদে বরিশাল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় যোগদান করেন। এর বছর খানেক সেখানে চাকরি করে শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করিয়ে নেন। সেখানেও দের দুই বছর চাকরি করে মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলিয়ে হয়ে ৩৩ বছরের চাকরি জীবনের দুই যুগের বেশি এখানেই চাকরি করেন তিনি। মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকুরিকালে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ও সহকর্মীদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তটস্ত করে রাখতেন তিনি। পতিত হাসিনার সরকারের শেষ সময়ে তিন ভাইয়ের ক্ষমতার প্রভাবে সহকারী প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়ে গত ১৬ মে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে মাউশির ঢাকা আঞ্চলিক অফিসে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে পদায়ন বাগিয়ে নেন। এখানে এসেই দুর্নীতি ঘুস বাণিজ্য এবং ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সহকর্মীদের তটস্ত করে রাখছেন তিনি। তবে সরকারের বদল হলেও এবং তার ভাই আয়নাঘরের মাস্টারমাইন্ড জিয়াউল হক চাকুরিচ্যুত ও গ্রেফতার হয়ে জেল হাজতে থাকলেও এবং ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক অবসরে চলে গেলেও তার ক্ষমতা প্রভাব কমেনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক নাজমুন নাহার তদন্তে অর্থ নেওয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকা শহরে টানা দুইযোগের বেশি কর্মরত থাকা শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, যে প্রধান শিক্ষক অভিযোগ দিয়েছেন তার কত বড় সাহস আমি তার কাছে লিখিত চেয়েছি তার সহকারী প্রধান শিক্ষক দিলেও তিনি দেননি। আর আমার ভাই জিয়াউল আহসান এর প্রসঙ্গ এখানে আসবে কেন? আর ঢাকা শহরে কতবছর চাকরি করি তাতে কি সমস্যা। আপনি লিখিত অভিযোগের কপি আমাকে পাঠান। আমি এখনও কথা বলছি তার সাথে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক রেবেকা সুলতানার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৯/১০/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.