ড. রুবাইয়া মোরশেদ: জুলাইয়ের শেষ দিন যখন সাড়ে তিন বছরের ডক্টরেট জীবন গুছিয়ে দেশের উদ্দেশে যুক্তরাজ্য থেকে প্লেনে উঠি, কল্পনায় ছিল না যে ঠিক এক সপ্তাহ পর এ অবস্থা হবে। বাংলাদেশ স্বৈরাচারমুক্ত ও নতুন করে স্বাধীন হলো। গণভবন থেকে লুটপাট হলো। লুটপাট করা জিনিস ফেরত নেয়া হলো, ফেরত দেয়াও হলো। নতুন প্রজন্ম সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা শুরু করল, রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করা শুরু করল। হঠাৎ করে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়, মন্দির, দোকানপাট ও বাসা আক্রমণ শুরু হলো। সেটা ঠেকাতে ছাত্রছাত্রীরা, এমনকি মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরাও মন্দির পাহারা দেয়া শুরু করল।
এ সবগুলো ঘটনা দেখে সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট হিসেবে মনে যে প্রশ্নটা জেগেছে তা হলো মানব ব্যবহার ও মানব চিন্তা কী দ্বারা প্রভাবিত হয়? অন্য কথায়, মানুষ কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং সিদ্ধান্তে অনুধাবিত হতে কীভাবে চিন্তা করে? সবাই তো একইভাবে চিন্তা করে না, করবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই যে কেউ লুটপাট করে, কেউ লুটপাট করা জিনিস ফেরত নেয়—চিন্তার এ পার্থক্যের সূত্র কী? মূল কথা, কীভাবে মানুষের ব্যবহার, চিন্তা, উপলব্ধি ও কার্যকলাপকে প্রভাবিত করা যায়? নৈতিকতার দিক থেকে চিন্তা করলে, কারো চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করা কি ঠিক? সবাই সবার মতো করে চিন্তা করবে, সবাই স্বাধীন, যে যার ইচ্ছামতো কাজ করবে, এটাই তো স্বাধীন রাষ্ট্র তাই না? হ্যাঁ এবং না।
হ্যাঁ, সবারই চিন্তা, চেতনা ও যার যা মনমতো কাজ করার স্বাধীনতা অবশ্যই আছে—যতক্ষণ না সেইটা অন্য কারো স্বাধীনতা বা অধিকারকে খর্ব না করে। এই যে অন্য কারো ক্ষতি না করে নিজের মনমতো কিছু করা, ক্ষতি হলে অন্যের হক নষ্ট করে তা না করা—এভাবে চিন্তা করতে শিখতে হয়। এখানেই শিক্ষার অনুপ্রবেশ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং এর বাইরে প্রতিদিনের জীবনযাপনে আশপাশের, সমাজের ও পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা।
শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব মানুষের চিন্তাভাবনা ও ব্যবহারকে প্রভাবিত করা। এটাই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। যেকোনো কিছু পড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে জানা এবং সেই জানাকে নিজেদের চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের বিকাশে সঞ্চালিত করা। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন যে, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ঘুম ভাঙানো—অন্য কথায়, চিন্তা ও কল্পনার উন্মেষ সাধন’। তবে এ পুঁজিবাদী সমাজে আমরা আজ শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সংকুচিত করে ফেলেছি শুধু শ্রমক্ষমতা উৎপাদনে, চাকরি-বাকরি পাওয়ায় এবং টাকা-পয়সা করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনে। অথচ আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে শিক্ষার আরেকটা উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবমন ও চিন্তার উন্নয়ন সাধন। এটা হচ্ছে এমন অবস্থা যে একটা গাড়ি কিনে সেই গাড়িকে খুব টাকা-পয়সা ঢেলে বাইরে চকচক করে রঙ করে সাজানো, ফুলসজ্জা দিয়ে রঙিন করে তুলে এরপর আবিষ্কার করা যে গাড়ির চাকা লাগাতে ভুলে যাওয়া হয়েছে। গাড়ি যতই সাজানো হোক, চাকা ছাড়া গাড়ি চলে না। তেমনই যতই দালানকোঠা তোলা হোক, উন্নয়ন হোক—শিক্ষার মাধ্যমে মানবমনের বিকাশ না হলে জাতি সামনে এগোতে পারে না।
এজন্যই আরো বেশি আশ্চর্য হই যখন দেখি নতুন প্রজন্ম অন্যায়কে অন্যায় বলে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করে ফেলে, দেশের ভালো-মন্দ চিন্তা করে রাস্তার ট্রাফিক কন্ট্রোলে নেমে যায়। যেখানে তারা শিক্ষা ব্যবস্থা বা পূর্ববতী প্রজন্ম কোনোটি থেকেই এসব করার তেমন অনুপ্রেরণা কখনো পায়নি। এটা একটা বড় রহস্য এবং গবেষণার সুযোগ যে এ নতুন প্রজন্ম কেন এবং কোন অনুপ্রেরণায় দেশের হাল ধরল এমন নিঃস্বার্থভাবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যোগ দিল যেখানে কোটা নিয়ে ওদের অত স্বার্থ নেই, ছোট ছোট শিশু রাস্তায় নেমে গেল যেখানে বড়দের ওরা সবসময় দেখেছে শুধু খাবার টেবিলেই দেশের সিস্টেমের দোষ ধরতে। ওরা কোথা থেকে শিখল এমন রক্ত গরম মাথা ঠাণ্ডা বাঘের বাচ্চাদের মতো লড়াই করতে? এটুকু পরিষ্কার যে শিক্ষা ব্যবস্থার খুব কম অবদান এখানে এবং সমাজেরও খুব কমই অবদান। কারণ সমাজ এতদিন তাদের এমন কিছু করতে তেমন উদ্বুদ্ধ করেনি—কেবল চেষ্টা করেছে তাদেরকে বিসিএস দিতে উদ্বুদ্ধ করতে, টাকা-পয়সা করতে বা বিদেশে চলে যেতে।
সমাজ যে অর্থকেন্দ্রিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক অভিভাষ্য দিয়ে সাফল্যকে সংজ্ঞায়িত করেছে নতুন প্রজন্মের কাছে, সে নতুন প্রজন্মই চোখে আঙুল দিয়ে সমগ্র জাতিকে দেখিয়ে দিল যে নিজে ওপরে ওঠার লোভ সামলিয়ে ঠিক কে ঠিক এবং ভুলকে ভুল বলে মেরুদণ্ড সোজা করে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়। এটা অনেক শিক্ষিত সাফল্যমণ্ডিত লোকজন কোনোদিন করে দেখাতে পারেনি। এ ধরনের নৈতিকতাহীন শিক্ষা ও সুবিধাবাদী সাফল্যকে আর শোভামণ্ডিত করা যাবে না ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কোনো পর্যায়েই।
এ নতুন সূচনালগ্নে পুনরুজ্জীবিত বাংলাদেশে যা যা ঘটছে বা সামনে ঘটবে— সবকিছুতে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে। ছোটরা পথ দেখিয়ে দিল, এখন বড়দের পথটা গড়ে তোলার পালা। আমি বড় না, একদম ছোটও না। সেজো প্রজন্মের একজন একাডেমিক হিসেবে আমার অবদান হচ্ছে মূলত আমার চিন্তা ও আমার গবেষণালব্ধ অভিব্যক্তি। আমি একজন অর্থনীতিবিদ যার বিশেষীকরণ শিক্ষা বিষয়ে। তাই বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুঁটি মাছ হলেও কাজ ও আগ্রহ উভয় সূত্রেই শিক্ষা নিয়ে সবসময় চিন্তাভাবনা করি। সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি ইউনিসেফের সঙ্গে।
নতুন শিক্ষাক্রমের কিছু ভালো দিক তো অবশ্যই আছে। অবশ্যই আরো সংস্কার প্রয়োজন। এর আগে আমাদের ঠিক করা উচিত আমরা শিক্ষিত বলতে কী বুঝতে চাই এবং একটা ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে কী আশা করি। অনেক উচ্চতর ডিগ্রিসম্পন্ন ‘শিক্ষিত’ সুশীলরা তো অন্যায়কে এতদিন অন্যায় বলার বদলে সুবিধা ভোগ করেছেন—এটাকে কী আসলেই শিক্ষিত বলা উচিত? শিক্ষিত কথাটির সংজ্ঞা বদলাতে হবে আমাদেরকে এবং যথাযথভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে মনোযোগী হতে হবে। তবে এ সংস্কার ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া যাবে না—আমি বললাম বা কোনো রুই-কাতলা এসে বলল বলে কোনো পরিবর্তন হওয়া উচিত না। যেকোনো পরিবর্তন বা সংস্কার হতে হবে গবেষণালব্ধ ও তথ্যভিত্তিক—পদ্ধতিকেন্দ্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এখানেই নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা—আজ পর্যন্ত নেয়া যেকোনো সংস্কারেরই সমস্যা এখানে। কেন সংস্কার হচ্ছে বোঝা গেলেও কীভাবে কী পদ্ধতি মেনে সংস্কার হলো তা কখনো বোধগম্য হয় না।
আমার যতটুকু পড়াশোনা তা থেকে আমি এটুকু সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমাদের পুরনো শিক্ষাক্রমের সংস্কার দরকার ছিল, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থারই সংস্কার প্রয়োজন। এ নতুন শিক্ষাক্রম একটি ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে যদি এর ওপর আমরা আরো প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারি। কিন্তু বিগত সরকার এ নতুন শিক্ষাক্রম এমনভাবে হঠাৎ করে চাপিয়ে দিয়েছিল জাতির ওপর—তাও আবার স্বাভাবিকভাবেই অতিষ্ঠ ও সরকারের ওপর অবিশ্বাসী একটি জাতির ওপর—যে নতুন শিক্ষাক্রমকে খুব কম মানুষই নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ বা মূল্যায়ন করেছে। এখন এ নতুন বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষাবিদ গবেষকদের সুযোগ দেয়া হোক নতুন ও পুরনো শিক্ষাক্রম নিয়ে গবেষণা করার। হুটহাট একটা নতুন শিক্ষাক্রম কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়া আরোপ করাও যেমন একটা সমস্যা, একইভাবে হুটহাট আলাপ-আলোচনা না করে বাতিল করে দেয়াও সমস্যা।
এরপর তো রয়েই যায় সেসব প্রশ্ন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় বড় সিদ্ধান্ত কারা নেন, কীভাবে নেন? সেখানে গবেষক কতজন থাকেন? কীভাবে গবেষকদের বাছাই করা হয়? এসব ব্যাপার খোলাসা করার সময় এখনই। আপনারা যারা শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব নিচ্ছেন, আপনারা যা-ই করেন, দয়া করে একই ভুল করবেন না—ভালো গবেষণার মূল্যকে অবহেলা করবেন না, পদ্ধতিকেন্দ্রিক না হয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবেন না, শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করা ও গবেষণা করা পারদর্শীদের অবজ্ঞা করবেন না।
এটাও অবশ্য স্মরণে রাখতে হবে যে শুধু শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় না। শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি এখানে আইন ও সুশাসনের ভূমিকা আছে। মোটা দাগে নতুন বাংলাদেশে তিনটি ক্ষেত্রের পরিবর্তনে এবার কোনো ভুল করার সুযোগ নেই—শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা ও প্রশাসনের সর্বস্তরের সিস্টেম। অনেক শিক্ষিত মানুষ দুর্নীতি করে কেন? আইন ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে বলে। দেশে রাস্তায় আইন অমান্য করা ব্যক্তি বিলাতে গিয়ে নিয়ম মেনে গাড়ি চালায় কেন? কারণ সেখানে নিয়ম অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থার মোকাবেলা করতে হয় ধনী-গরিব সবাইকে। এটাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বয়ংক্রিয় আইন ব্যবস্থার ফলাফল—মানুষ নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হয়, কারণ ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই, ঘুস দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার ফাঁকফোকর নেই। এটাই সিস্টেম বা ইনস্টিটিউশন। শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের পাশাপাশি আইন ও প্রশাসনকে সংগঠিত না করে এগোনো যাবে না—গাড়ি রওনা দিলেও গাড়ির চাকা বারবার ফুটো হয়ে যেতে থাকবে।
এসব সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়, কিন্তু সম্ভব। এ ধরনের সংস্কার সম্পন্ন করতে সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হচ্ছে সাহস ও সৃজনশীলতা। সাহস নতুন প্রজন্ম জাতির মধ্যে জাগিয়েছে। এখন প্রবীণদের দায়িত্ব হচ্ছে সৃজনশীলতার পরিচয় দেয়া—অনেক সময় যথাযথ নিয়মের বাইরে গিয়ে, হয়তো বা সংবিধানকে অমান্য করেই। নিয়ত যদি ভালো হয়, তাহলে সাহস ও সৃজনশীলতার সংমিশ্রণ শক্তিশালী ওষুধ আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য। দেশটা এখন অসুস্থ একজন রোগীর মতো। দেশটাকে মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচাতে অনেকে জীবন দিয়েছে, দেশকে এবারের মতো মৃত্যু থেকে বাঁচানো গেছে। কিন্তু দেশ এখনো সুস্থ হয়নি, রাতারাতি হবেও না। দীর্ঘদিনের চিকিৎসা লাগবে, ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু অন্তত বাঁচানো যে গেছে—এটাতে শুকরিয়া করতে হবে, ভরসা রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের মাঝে অনেকে আজ নেই যারা জীবন দিয়েছে যেন আমরা দেশটার চিকিৎসা করার সুযোগ পাই।
লেখক: সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ থেকে পিএইচডি অর্জন করে দেশে ফিরেছেন। প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৯/০৮/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.