এইমাত্র পাওয়া

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আসন্ন বাজেটে জাতীয়করণের বিকল্প নেই

প্রদীপ কুমার দেবনাথ: আধুনিকতার ঢেউ দেশের সবকিছুতেই। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে নতুনত্বের জয় জয়কার। নতুনত্ব প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রেও। নতুন শিক্ষাক্রমে কাঙ্খিত আধুনিকতার আভাস স্পষ্ট। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মহৌষধি হিসেবে কাজ করবে সন্দেহ নেই। তবে এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নে দরকার সহায়ক ব্যক্তির পরিপূর্ণ রসদ যোগান ও প্রতিষ্ঠানের বাস্তবমুখী আধুনিকায়ন। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল আসল উপকরণ। সেই শিক্ষককে প্রাচীন পদ্ধতির ভাতা আর প্রতিষ্ঠানকে সংকোচিত করে রাখলে এ শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সত্যিকার অর্থে শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও বটে। আদর্শ শিক্ষক আর উপযোগী অবকাঠামো শিক্ষার মানোন্নয়নে এক নম্বর নিয়ামক। সবকিছু ছাপিয়ে এ কারিকুলাম বাস্তবায়নের গুরু দায়িত্ব কিন্তু শিক্ষকদের। অথচ আর্থিক, মানসিক, প্রাতিষ্ঠানিক পীড়নে জর্জরিত শিক্ষক কতটুকু সফলতা এনে দিতে পারে এ কারিকুলাম বাস্তবায়নে ?

আদর্শ আর শ্রেষ্ঠ পেশার প্রকৃষ্ট উদাহরণ শিক্ষক। একটি জাতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে আর প্রকৃত যোগ্য নাগরিক হয়ে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলনযোগ্য মানুষ তৈরিতে শিক্ষক দক্ষ কারিগর। অথচ এই জাতি গঠনের কারিগর, জাতির বিবেক, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান খ্যাত শিক্ষকরা আজ বড় অসহায়। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী জাতির এ বাতিঘর দের করুণ জীবন-যাপন, কষ্টের দিনাতিপাত, তাদের অসহায়ত্ব, সীমাহীন কষ্টের নিদারুণ প্রাত্যহিক জীবন যেন আদিম কালকেই হার মানায়। বর্তমানকালে শিক্ষকতার পেশাটাই যেন এক অভিশাপের নাম।

স্কুল জীবনে লক্ষ্য নির্বাচনে শিক্ষকতাকেই আমরা অনেকে নির্ধারণ করি। তখন মনে থাকে রঙ্গিন স্বপ্ন। আমাদের শিক্ষকদের হাসি মাখানো মুখ, সুন্দর পরিপাটি থাকা, গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলা ও চমৎকার অঙ্গভঙ্গি দেখে আমরা কখনও অনুভব করতে পারিনা যে একজন শিক্ষক কত কষ্ট, কত অভাব ও কত যন্ত্রণা মনে পোষণ করে এখানে হাসিমাখা মুখ নিয়ে আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কখনও ভাবিনা মাত্র ১২০০০ থেকে ২৫০০০ টাকায় কিভাবে চলে একজন শিক্ষকের পরিবার?

‘শিক্ষক’ শব্দটিতেই কেমন একটা গাম্ভীর্যের ছাপ থাকে, শব্দটিতে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা আর আভিজাত্য সবকিছুই মিশেল। এই গাম্ভীর্য, আভিজাত্য সবকিছু টিকিয়ে রাখতে চাই প্রয়োজনীয় রসদ। চাই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক অবস্থান ও রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতার কাজে শিক্ষকদের নিয়োগ প্রদান করা হয়। আর বিপরীত চিত্র আমাদের দেশে।এখানে নেই শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা,নেই রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মর্যাদা,নেই বাস্তবমুখী দিকনির্দেশনা। সর্বত্রই এলোমেলো অবাস্তব সিস্টেম। সরকারি বেতন কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি ও উচ্চশিক্ষায় লেজেগোবরে অবস্থা। এমপিওভুক্তি নামক পদ্ধতিটিই শিক্ষকদের জন্য এক বিষফোঁড়া। এই পদ্ধতিতে নব্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের সকল কাগজপত্র আপডেট থাকার পরও অনলাইন আবেদন করলে দেখা যায় হঠাৎ জারি হওয়া পরিপত্র মোতাবেক আবার নতুন করে কাগজপত্র দাখিল করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে কর্তাদের নিজস্ব জারি করা আদেশে দীর্ঘসূত্রতা শুরু হয় এমপিওভুক্তিতে, চলে মাসের পর মাস বছরের পর বছর। দুশ্চিন্তা এবং চরম উৎকন্ঠায় কাটানো শিক্ষকগণ অবশেষে এমপিওভুক্ত হলেও স্বল্প বেতনে কষ্টের জীবনযাপন শুরু হয়। আশায় বুক বাঁধে হয়তো স্বল্পতম সময়ে পেয়ে যাবে জাতীয়করণ। স্বপ্ন আজীবনই স্বপ্ন হয়ে থাকে। এক সময় চাকরির মেয়াদ শেষ হয়।মেয়াদ শেষে যেখানে নিয়মমাফিক নিজের সঞ্চিত কল্যাণট্রাস্ট ও অবসরভাতা পাওয়ার কথা, সেখানে শুরু হয় আরও চরম ভোগান্তি। এখানে আরও এলোমেলো অবস্থা। দফায় দফায় কাগজপত্র নেওয়া শুরু হয়। একটার পর একটা এভাবে সব চাহিদা পূরণ করার পরও, বছরে ৩৫ বার অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের কর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে করতে না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও জুটেনা চাকরী কালীন সময়ে জমানো অর্থ। এ যেন কল্যাণ নামক অকল্যাণের ভূত অসহায়, বৃদ্ধ, শারীরিক ভাবে অক্ষম জাতির বিবেকদের জীবনে খরগ হয়ে দেখা দেয়।

যে শিক্ষক সংসার চালাতে প্রতিমাসে মহাজনি ঋণে আবদ্ধ হচ্ছে, অভাব আর প্রতিকূলতায় প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে বাস্তবে সে শিক্ষক কি নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের হাতিয়ার? যে শিক্ষক অর্থাভাবে সন্তানকে ভালো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারেনা, পিতা-মাতা, স্ত্রীর চিকিৎসা করতে পারেনা, আত্মীয়দের সামান্য আবদার মিটাতে অক্ষম, সেই মানসিক বিপর্যস্ত শিক্ষকের দ্বারা মোটেও শ্রেণিকক্ষে আন্তরিক পাঠদান ও বর্তমান কারিকুলাম অনুযায়ী শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। কারিকুলাম বাস্তবায়নের মূল নায়ক শিক্ষকদের আর্থিক সচ্ছলতা প্রয়োজন সবার আগে। রাগ দেখিয়ে, হুংকার দিয়ে, হুমকি ধমকিতে কখনও ফলপ্রসূ সফলতা পাওয়া যায় না। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তবিক উদ্যোগ যা উদ্দেশ্য সাধনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

আর বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে জাতীয়করণের বিকল্প নেই । জাতীয়করণ করতে এ বাজেটেই বরাদ্দ প্রদানের পক্ষে অধিকাংশ শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষা প্রদানে নিযুক্ত জাতির মহান কারিগররা। জাতীয়করণের মাধ্যমে জাতির পথপ্রদর্শক শিক্ষকগণ হবেন দুশ্চিন্তা মুক্ত, নির্ভার। তারা দুশ্চিন্তার খোলসমুক্ত হলে শিখন শেখানে কার্যক্রমে গতিশীলতা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের সবচেয়ে কঠিন বাঁধাটি বিলুপ্ত হবে। তাছাড়া জাতীয়করণ হলে শিক্ষকতার পেশায় আসবে গতি, নতুন ও সবচেয়ে মেধাবীরা আসবে শিক্ষকতার পেশায়। বাড়বে সৃজনশীলতা। যুগোপযোগী ও বহিঃ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সময়োপযোগী শিক্ষার প্রকৃত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদর্শ নাগরিক গঠন করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রুপ নিবে।

লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যম কর্মী

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/৩০/০৫/২২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.