Breaking News

নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম: সরকারের ভাবনা ও মাঠের বাস্তবতা

মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভূঞাঃ শিক্ষাব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর ঘটাতে সরকার নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম চালু করেছে। উদ্দেশ্য- গতানুগতিক মুখস্থবিদ্যা ও পরীক্ষানির্ভরতার পরিবর্তে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা। যেখানে শিক্ষার্থীরা পড়ে নয়, করে শিখবে।

লেখাপড়া হবে ভয়ডরহীন নান্দনিক ও আনন্দময় পরিবেশে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একটা অভিজ্ঞতার ভেতরে নিয়ে যাবেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা ধাপে ধাপে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করবেন। শ্রেণি কক্ষে শিক্ষক একজন পরিচালক ও সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকবেন।

প্রতিটি অভিজ্ঞতায় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে একক কাজ, দলীয় কাজ, মডেল তৈরি করে উপস্থাপন ও ভূমিকাভিনয় করবেন। সিমুলেশন, পাঠ্যবইয়ের কাজ, বাড়ির কাজ করবেন। প্রতিবেদন প্রণয়ন ও অ্যাসাইনমেন্ট করবেন। শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা অর্জনকালীন শিক্ষক, অভিভাবক ও ক্ষেত্র বিশেষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেবেন। এভাবে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থেকে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করবেন।

প্রতিটি অভিজ্ঞতা অর্জনকালে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন বর্ণিত অভিজ্ঞতা কে কতটা অর্জন করতে পেরেছে। অভিজ্ঞতা অর্জনে কেউ পিছিয়ে থাকলে তাকে বাড়তি সময় দিয়ে অগ্রগতির পথে নিয়ে আসবেন।

এভাবে ৫ বছরে মাধ্যমিক পর্যায় শেষে একজন শিক্ষার্থী ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, শিল্প ও সংস্কৃতি এই দশটি বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করবেন। ফলে দেশ পাবে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে দ্রুত অভিযোজনে সক্ষম জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, সংবেদনশীল, মানবিক ও দেশপ্রেমিক নাগরিক।

শিক্ষায় যে কোন সংযোজন ও পরিবর্তনের ভিশন এমনই চমকপ্রদ হয়। অতীতে ইংরেজি শিক্ষায় কমিউনিকেটিভ অ্যাপ্রোচ, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি কিংবা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাস্তবে এর কোনটিই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

অনেক আশা ও সম্ভাবনার নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি। প্রয়োজন ছিল আটঘাট বেধে নমনীয় ও জুতসই পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার। তা না করে অকারণ তাড়াহুড়োতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়েছে এর। দুই দফায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ হলেও শিক্ষাক্রম রূপ রেখায় (মূল্যায়নে) পরিবর্তন আনায় আবার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়বে। এতে সময় ও অর্থ দুটোরই অপচয় হবে। দুইবার শিক্ষক প্রশিক্ষণ হলেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল দেওয়া যায়নি। ফলে চোখের দেখা আর আলাপ আলোচনায় শেষ হওয়া প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজে নেমে হোঁচট খাচ্ছেন শিক্ষকগণ।

বলা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বিষয় শিক্ষকগণ সম্পূর্ণভাবে টিজি (টিচার্স গাইড) দ্বারা পরিচালিত হবেন। টিজি ছাড়া সফলভাবে একটি ক্লাসও পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অথচ টিজি সরবরাহ করা হয়েছে চাহিদার অর্ধেকেরও কম! এই নিয়ে শিক্ষকগণ জোড়াতালিতে চলছেন কোনোমতে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে জারি করা সর্বশেষ মূল্যায়ন নির্দেশিকা পুস্তিকা আকারে শিক্ষকদের সরবরাহ করার প্রয়োজন থাকলেও তা না করে পিডিএফ ফাইল করে অনলাইনে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকগণ এটি প্রিন্ট করে বই বানিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন এবং ক্রমে এতে অভ্যস্ত হচ্ছেন। সামনে আবার নতুন মূল্যায়ন নির্দেশনা আসবে। আড়ায় বছর পরে আবার নতুন শুরু হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট কোচিং লাগবে না, এমনটাই জানানো হয়েছিল। কিন্তু মাঠের ফল ভিন্ন। প্রাইভেট কোচিং কমেনি বরং বেড়েছে আশাতীতভাবে। সম্প্রতি গণস্বাক্ষরতা অভিযানের গবেষণা প্রতিবেদন “এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩” এ ওঠে এসেছে – প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তিন-চতুর্থাংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটর কিংবা কোচিং সেন্টারে গিয়েছে। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের শুরুতেও রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে প্রাইভেট কোচিং এর একই চিত্র দেখা গেছে। নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দলে দলে কোচিং করছে। এতে শিক্ষা ব্যয় আগের থেকে বেড়েছে। শিক্ষকগণের ধারাবাহিক মূল্যায়নের ফলাফল এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করলে এর নির্ভরযোগ্যতা রক্ষা করা অসাধ্য হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে এবং অকারণে প্রাইভেট কোচিং করতে বাধ্য হবে।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের বারোটা বাজাচ্ছে গাইড বই ও ইউটিউব কনটেন্ট। কোন বিষয়ের একটি অজানা অভিজ্ঞতা পাঠ্যপুস্তকের আলোকে ও শিক্ষকের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের ধাপে ধাপে অর্জন করার কথা, অথচ তা গাইডবই ও ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কার্যত কোন যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই মূল্যায়নের ধাপগুলো অনায়াসে অতিক্রম করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের মডেল ইউরোপের উন্নত দেশ থেকে এসেছে। সে সব দেশে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত প্রাথমিকে ১:১৫ ও মাধ্যমিকে ১:২৫ এর কাছাকাছি হলেও আমাদের দেশে তা প্রাথমিকে ১:৩০ ও মাধ্যমিকে ১:৪৫ কিংবা তারও বেশি। এছাড়াও আমাদের শ্রেণি কক্ষগুলো নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সহায়ক নয়।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের কাজ বেড়েছে অনেক। শিক্ষকগণ আন্তরিক না হলে এই শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন সহজ হবে না। অথচ বেসরকারি শিক্ষকদের সামান্য দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সরকার পরাঙ্মুখ। তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত না করলে, জীবনমানের উন্নতির খেয়াল না করলে তাদের থেকে আন্তরিক সেবা ও সমর্থন পাওয়া সহজ হবে না।

শিক্ষা ক্ষেত্রে এ বিশাল রূপান্তর ঘটাতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল যা পাওয়া যায়নি। বাজেট স্বল্পতায় পাঠ্যপুস্তকের মানে ছাড় দিতে হয়েছে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, মূল্যায়ন নির্দেশিকা ও টিজি সরবরাহ করা যায়নি। এমনকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ভাতাও সময়মতো পরিশোধ করা যায়নি। শ্রেণি কক্ষের মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে শিক্ষায় বাড়তি বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এমন দাবিই শোনা যায়নি। এ ছাড়া শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং ও গাইডবই বন্ধে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ এই পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তাই বলা যায়, নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন অনেকগুলো যদি – কিন্তু’র উপর নির্ভর করছে। সেসবের জুতসই সমাধান ছাড়া সাফল্য প্রাপ্তি প্রলম্বিত হতে পারে।

লেখক: শিক্ষক।

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৬/০৪/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

বিসিএস আন্তক্যাডার বৈষম্যের অবসান হবে কবে

তুহিন ওয়াদুদঃ বিসিএস ক্যাডারের পদোন্নতির নৈরাজ্য আজও দূর করা সম্ভব হয়নি। বিসিএসে এক ক্যাডারের সঙ্গে অন্য …