এইমাত্র পাওয়া
ফাইল ছবি

শিক্ষার বহুমুখী সম্ভাবনা ও একমুখী চাহিদা

শারমিন সুলতানাঃ বর্তমান বাজারে যখন শিক্ষা একপ্রকার পণ্য কারো কারো কাছে তখন এর ভোক্তার সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসে প্রায়ই। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই শিক্ষা চাকরি প্রাপ্তির টিকেটের মতো। সাময়িকভাবে যে দরের টিকেট চাকরি প্রার্থীকে যতদূর নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করা হয় সে দরের টিকেটই শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হয়। বলছি ভালো সাবজেক্ট আর খারাপ সাবজেক্টের কথা। যার মেধা ও সামর্থ্য আছে সে এক নম্বর সারির বিষয়গুলো নিয়ে চাকরির বাজারে নামবে এবং যার মেধা ও সামর্থ্য কম সে দুই বা তিন নম্বর সারির বিষয় নিচে মাঠে নামবে। এ যেন কোনো বর্ণপ্রথা। ফলে শিক্ষার্থী জীবনের শুরুতেই হতাশ হয়ে বসে পড়ে এক কোনায়, যেখান থেকে নিজেকে শিক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কার করা তো দূরের কথা, একজন শিক্ষার্থী সঠিক চিন্তাই করতে পারে না যে তারও করণীয় কিছু আছে বা থাকতে পারে।

এমতাবস্থায় বিদ্যা ও জ্ঞান, মেধা ও মনন, আবর্তন ও পরিবর্তন দূরসম্পর্কের অনাত্মীয় হয়ে পড়ে থাকে। শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের আয়ু শেষ হয়ে যায়, তবুও ভুলক্রমে জ্ঞানের আলো তার অন্ধকারে ছায়া ফেলতে পারে না। চাকরি বা প্রতিষ্ঠার চিন্তা তার ভেতরে শুভ বোধটাকে গ্রাস করে অক্টোপাসের মতোন। ওই আড়ষ্ট অবস্থায় বাধ্য হয়ে গ্রন্থ মুখস্থ হয় বটে, শিক্ষার পরশে পরিবর্তন আর হয় না কখনোই।

আমাদের চারপাশে কতগুলো প্রতিষ্ঠিত বিষয় আছে যেগুলো সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য হুমকির স্বরূপ হয়ে কল্যাণ বা সুন্দরের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেগুলো হয়তো কোনো বদ্ধমূল ধারণা, কোনো নিয়ম কোনো প্রথা, কোনো অনুশাসন, কোনো ব্যবস্থা, কোনো আচরণ কিংবা বিধান। পরিবর্তন প্রয়োজন। মূলটাকে ক্ষেত্রবিশেষে নতুন করে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সুন্দরের পক্ষে। আর সেই পরিবর্তন আনয়নের দায়ভার পড়ে শিক্ষার ওপর। কিন্তু শিক্ষা যখন নিজেই একমুখী প্রয়োজনের অপমানে অপমানিত তখন তার সম্ভাবনা কতটুকু পেখম মেলে চারপাশকে সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিতে পারবে সেটি শিক্ষার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

সময় বন্ধক রেখে ভোক্তা যখন শিক্ষাকে কিনে নিয়ে পরক্ষণেই তার বিনিয়োগ করে অর্থমূল্য পেতে চায় তখন শিক্ষা শ্বাসকষ্টে ভোগে প্রবল। চাহিদার সাথে লড়াই করে করে বিকশিত হওয়ার আগেই তা তার ভোক্তার মনন থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় এবং বেরিয়েও যায়। ফলে শিক্ষার প্রয়োগে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন তো হয়ই না, উল্টো আরো কিছু বিশ্রি বিষয় প্রতিনিয়ত জন্মের উৎসবে অসামঞ্জস্যতা বাড়ায়। আর আমরা ভাবি এত উন্নয়নের ভেতরও অসুন্দর কেন ডালপালা গজিয়ে স্বর্ণলতার জন্ম দিচ্ছে। অথচ হিসাব করলে দেখা যায়, শিক্ষা পণ্যের ভোক্তারাই শিক্ষার বহুমুখী কর্মক্ষমতা নিয়ে সচেতন নন। তাই তারা শিক্ষাবৃক্ষের কাছ থেকে তরুলতা, কলি বা ফুল না নিয়ে কেবল শুষ্ক ফল প্রত্যাশা করে। অতঃপর সৌন্দর্যহীন শুষ্ক ফলে ফলে বাগান ভরে জোর করে। আমাদের কাক্সিক্ষত ও একান্ত প্রয়োজনীয় পরিবর্তন অধরাই থেকে যায়।

সত্যিকার অর্থে আমরা শিক্ষার প্রায়োগিক সত্তার ক্রিয়াশীলতা খুঁজতে গেলে মোটের ওপর কিছুই পাই না। কারণ গ্রন্থগত বিদ্যার কোনো প্রায়োগিক ব্যবহার আমরা করিই না। শুধু উদরপূর্তির জন্য অর্থ উপার্জন ছাড়া। আর সেখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি। এক বিদ্যার মানুষ কর্মক্ষেত্রে গিয়ে করে অন্য বিদ্যার চাষবাস। ফসল যে একেবারেই তাতে আসে না তা নয়, তবে অপচয় হয় বিদ্যার সম্ভাব্য উচ্চ ফলনের। কেননা শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য মস্তিষ্কের জমিনে সার দিয়ে সভ্য আচরণ ফলানো। আর তাতে উর্বরতা বৃদ্ধির উপকরণ সরবরাহ করে নব চিন্তা, নব প্রন্থা নব প্রস্তুতি। তা করতে পারলে উদর পূর্তির সংস্থানও হয় আর মনের সুন্দর ও শান্তির পক্ষেও কাজ করা যায়। কিন্তু আমরা তো এসব থেকে অনেক দূরে। গ্রন্থগত বিদ্যার প্রয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে আমরা কেবল চিনি একটি জায়গা যার নাম পরীক্ষার হল। তাই এর প্রয়োগ ক্ষেত্র যে সীমাহীন অবারিত জীবন তা আমরা জানিই না আর জানলেও মানি না। শিক্ষা কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য প্রধানত জানা, বোঝা, অনুধাবন, পরিবর্তন, সংশোধন ও উদ্ভাবন।

জানার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা হয়, বোঝার মাধ্যমে সেই অর্জনের গভীরতা অনুভব করা হয়, অনুধাবনের মাধ্যমে করণীয় কার্য নির্ধারণ করা, কার্য নির্ধারণের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন ও সংশোধন করা যায় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এটিই উদ্ভাবন ঘটায়। এ বিষয়গুলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় একটির মধ্য দিয়ে আরেকটি পূর্ণতা পায়। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ মানুষই সরাসরি লাফিয়ে উদ্ভাবনের দিকে যেতে চাই। তাও আবার কর্মক্ষেত্রে কর্মপন্থা সহজ ও বেগবান করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবনই আমাদের একমাত্র অভিপ্রায়। এ জন্য আমরা দিন শেষে অধিকাংশ মানুষ কর্মী থেকে যাই, আবিষ্কারক হতে পারি না। কেননা আমাদের উদ্ভাবন প্রক্রিয়া দূরদর্শী হয় না। জানা, বোঝা, অনুধাবন ও কল্পনা শক্তি ইত্যাদিকে আমরা প্রাথমিক অবস্থায় প্রাধান্য দেই না। এ কারণেই আমাদের অধিকাংশের উদ্ভাবিত কর্মপন্থা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুষ্টিহীনতার রোগে মুখথুবড়ে পড়ে।

আমাদের গ্রন্থের বিদ্যা বই হতে মগজে আসে সাময়িক ঘোরাঘুরির জন্য। পরীক্ষার হলে পর্যন্ত ঘুরে সেটি আবার গ্রন্থেই ফিরে যায়। মগজ থেকে মননে আসে না। মুখস্থ বিদ্যায় তাই আমাদের অনেকের মাথা ঠাসা, আর প্রয়োগহীনতায় আত্মা ফাঁকা। এবং অর্থনেতিক শক্ত অবস্থা আমাদের সফলতা আর বাকি সবকিছুই আমাদের ব্যর্থতা। আমরা জীবনে সে হিসেবে ব্যর্থ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৪/১১/২০২৩

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.