গোলাম কবিরঃ সম্প্রতি একটি একটি গণমাধ্যমে সময়োপযোগী একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম ‘বিশ্ববিদ্যালয় কি কেবল সনদধারী বেকার উপহার দেবে’। বাংলাদেশে একদা শিক্ষার জন্য প্রবর্তিত মাধ্যমিক সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছাড়িয়ে এখন যত বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে তার কিঞ্চিৎ মোজেজা এখানে বর্ণিত।
কথাগুলো নতুন নয়, তবে পড়ে আমাদের দিবাস্বপ্ন ভাঙার কথা।
আমরা তথাকথিত শিক্ষিতরা নিজেদের স্বার্থে শিক্ষাকে এমন এক পর্যায়ে নামিয়েছি, যা দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন হাজিরার কাজও হয় না। এ নিয়ে ছিটেফোঁটা কথা আমরা বলেছি, কেউ শোনেনি। হয়তো শুনবে, যখন পোড় খাওয়া মানুষ ওই গলায় গামছা বাঁধা তথাকথিত উচ্চশিক্ষাকে ধিক্কারও দেবে না।
অচিরেই আরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তনের পরিকল্পনা আছে, তবে সেগুলো কি রূপদর্শনের জন্য! ঢাকা-চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-রাজশাহী-সিলেট-খুলনায় যে কটি বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান ছিল, তাই দিয়ে কি দেশের প্রয়োজন মিটছে না—এমন তথ্য উপস্থাপন কঠিন।
তবে বিনা শ্রমে গাড়ি হাঁকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাজতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা থানায় থানায় বাড়াতে হবে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা কতজন দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান পেয়েছেন তা হয়তো জোর করে আঙুল গুনেও দেখানো যাবে না।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার কিছুদিন পর বাংলাদেশের শিক্ষা ছিল হ-য-ব-র-ল। বঙ্গবন্ধু তা জানতেন, তাই জনগণ প্রদত্ত ক্ষমতায় আসীন হয়ে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ এবং ভবিষ্যতের উন্নত শিক্ষা ভাবনা মাথায় রাখেন।
এ সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য বেসরকারি সব মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান একযোগে দীর্ঘ সময় ধর্মঘট করে। বঙ্গবন্ধু নরম হননি। তিনি প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—সর্বত্র একটা দেশ ও কালোপযোগী সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। দেশের অগ্রগতির ধারাকে ১৯৭৫ সালের আগস্টে জাতির ঘাতকরা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। সেই ইতিহাস ৫০ বছর পার হয়ে গেছে।
নানা কিসিমের কমিশন গঠিত হয়েছে। অথচ আজও আমাদের শিক্ষা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি বলে শিকড় কাটা বৃক্ষের মতো মাথায় জল ঢেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আর মাঝে মাঝে ভিসি সেজে আসন দখলের যুদ্ধে রত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, কথিত দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে যায় মাত্র কয়েক শতাংশ। তা-ও আবার বিসিএসের বৈতরণি পারাপারের জন্য।
৬০ বছরেরও আগে থেকে আমি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেখেছি অনেকে আমরা মাতৃভাষিক একটা শুদ্ধ অনুচ্ছেদ লিখতে অপারগ। নানা কৌশলে আমরা তাঁদের শিক্ষক বানিয়েছি। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাড়িয়ে চলেছি। বাস্তবে যেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। সেখানে ভর্তি করিয়ে চোখ ঝলসানো সনদ দিয়ে দিচ্ছি। চাকরির বাজারে এসে তাঁরা অন্ধকার দেখছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফারসি ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে অনার্সও প্রবর্তিত হয়েছে। দুঃখের বিষয়, যাঁরা অনার্স পড়ছেন, তাঁদের অনেকেই পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখেন ভুল বাংলায়। এমনকি PhD-ও করা হয় একই কায়দায়। এখান থেকে আর যা-ই হোক ভাষাজ্ঞানী হওয়া কঠিন। ১৮৩৫ সাল থেকে দেশে ফারসির আধিপত্য কমতে থাকে। সমৃদ্ধ ফারসি সাহিত্য গত শতক পর্যন্ত অনেক আগ্রহী পড়েছেন সাহিত্যের আকর আর ধর্মীয় বিষয়ের বিশ্লেষক হিসেবে। এখন সেই প্রভাব প্রায় শূন্য। অথচ উর্দু-আরবি-পালি ইত্যাদি ভাষায় উচ্চশিক্ষার দরজা খোলা। তাঁরা বিদেশি ভাষার পণ্ডিত সাজতে গিয়ে ‘মানব ফিঙে’ হয়ে যাচ্ছেন। এ দুর্দশা থেকে আমরা কবে মুক্ত হব? এই একটা উদাহরণ বোধ করি যথেষ্ট। তবু অন্যান্য বিষয়ের কিছু কিছু ছাঁট বিষয়কে একটি পূর্ণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে বিষয়ের কলেবর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। একে ‘শিক্ষা তুঘলকি’ ছাড়া আর কি বলা যায়! এই সর্বনাশা অতিচিন্তা আমাদের শিক্ষার পরিণতিতে বেকার উৎপাদন করে চলেছে। জনগণের অর্থ এভাবে লোপাট হলে মানুষ অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়কে বেকার সহযোগী উৎপাদনের কারখানা হিসেবে উপহাস করবে।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৯/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.