সুভাষ বিশ্বাস, নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর অঞ্চলঃ ‘খালিশা চাপাণী আলিম মাদরাসায় গোপনে ৬ পদে নিয়োগ, জানেই না এলাকাবাসী‘ শিরোনামে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হবার পর নড়েচড়ে বসে এলাকাবাসী। এবার তারা বিষয়টির সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে এই নিয়োগ বাতিল চেয়ে একাধিক শিক্ষা দপ্তরে ও স্থানীয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
গত ১৪ আগস্ট ২০২৩ তারিখে শতাধিক এলাকাবাসীর স্বাক্ষরিত অভিযোগ পত্রটি ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, নীলফামারী জেলা প্রশাসক, দুর্নীতি দমন কমিশন, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর জমা দিয়েছেন।
নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপাণী বেপারীটোলা আলিম মাদরাসায় গোপনে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ৬ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর নিয়োগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এবং নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে কিছুই জানেন না এলাকাবাসী। এক কিংবা দুই জন নয় চার কর্মচারী ও প্রিন্সিপ্যাল, ভাইস প্রিন্সিপ্যাল পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও অতি গোপনে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী। অবৈধ এই নিয়োগ বন্ধে তারা সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেন।
শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত জুন মাসে এই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে এবং কত তারিখে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মাদরাসা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাদরাসাটিতে প্রথমে ছয় পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয় চলতি বছরের গত ১৮ মে । এসময় পদ ছিল (১) অধ্যক্ষ-১টি (পদটি শূন্য) (২) উপাধ্যক্ষ-১টি (৩) অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর-১টি (৪) নিরাপত্তা কর্মী-১টি (৫) আয়া-১টি (পদগুলো নবসৃষ্ট)। এরপর অফিস সহকারি কাম হিসাব সহকারি পদ বাড়িয়ে ২য় বার ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয় গত ৬ জুন। এই দুই বারই মাদরাসা অধিদপ্তরের ডিজির প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক মোঃ আবু নাঈম’কে।
ছয় জন নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন, অধ্যক্ষ পদে মোঃ আব্দুল মান্নান যিনি একই প্রতিষ্ঠানের উপধ্যাক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উপাধ্যক্ষ পদে হাফিজুর রহমান, অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারি পদে আসাদুজ্জামান লিটন যিনি মাদরাসাটির গভর্নিং বডির সভাপতি রহমতউল্লাহ মিয়া ছেলে। অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মুন্নি, নিরাপত্তা প্রহরী পদে মোঃ রিমন ও আয়া পদে মোছাঃ শামিমা।
জানা গেছে, খালিশা চাপাণী বেপারীটোলা আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মোঃ জয়নুল আবেদীন অবসরে গেলে মাদরাসাটির উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মান্নান অতি সুকৌশলী কোনো নির্বাচন ছাড়া খাতা কলমে নির্বাচন দেখিয়ে নিজের মতো করে একটি গভর্নিং বডি গঠন করে। অতি গোপনে খাতা কলমে গভর্নিং বডি গঠন করে অধ্যক্ষ পদে নিজের নিয়োগ নিজেই নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মান্নান। গভর্নিং বডির সভাপতির ছেলেকে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দিয়ে সব মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন মোঃ আব্দুল মান্নান।
দেশের ৯ সহস্রাধিক বেসরকারি মাদরাসায় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে কোনো পরীক্ষার্থীর নিকটাত্মীয় নিয়োগ কমিটিতে থাকতে পারবেন না। স্বচ্ছ নিয়োগের লক্ষ্যে গত ৬ জুন এমন নির্দেশনা জারি করেছে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। এ ছাড়া মাদরাসার উপাধ্যক্ষ, সহকারী সুপার, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ভারপ্রাপ্ত সুপার ও শিক্ষক-কর্মচারী ওই মাদরাসার কোনো পদে প্রার্থী হলে তিনি নিয়োগ কমিটিতে থাকতে পারবেন না। অথচ খালিশা চাপাণী বেপারীটোলা আলিম মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান নিজেই নিজের নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যক্ষ পদে। শুধু তাই নয় মাদরাসাটির গভর্নিং বডির সভাপতির ছেলেকে অফিস সহকারি পদে নিয়োগ প্রদান করা হলেও নিয়োগ বোর্ডে প্রতিনিধি হিসেবে সভাপতি রহমতউল্লাহ মিয়া নিজে উপস্থিত ছিলেন। যা মাদরাসা বোর্ডের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
লিখিত অভিযোগকারীদের মধ্যে স্বাক্ষরকারী একজন হচ্ছেন মোঃ ওবায়দুল ইসলাম। তিনি শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমার বাড়ীর পাশের মাদরাসা অথচ এত বড় একটা নিয়োগ হয়ে গেলো আমি কিছুই জানলাম না। নিয়োগটা এত গোপনে করা হয়েছে শুধু আমি নই এলাকার একটি মানুষও বিষয়টি জানে না। আমরা এই অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। আমরা তদন্ত স্বাপেক্ষে এই নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল চাই।
আর একজন লিখিত অভিযোগে স্বাক্ষরকারী মারুফ হোসেন সুমন। তিনি জানান, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল এবং সভাপতি অতি গোপনে এই নিয়োগ দিয়েছেন আমরা এর বিরুদ্ধে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা নিয়ে যেভাবে কাজ করছেন এদের মত মানুষ তার অন্তরায়।
স্থানীয় মোঃ শাহজাহান আলী শিক্ষাবার্তা’কে জানান, যদি গোপনে এই নিয়োগ না দিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হত তাহলে এলাকার অনেক বেকার মেধাবী ছেলেরা সুযোগ পেত। তারা প্রায় অর্ধ কোটি টাকা বাণিজ্যের মাধ্যমে এই নিয়োগ কার্যক্রম করেছে। আমার এর বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানাই।
লিখিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করবেন কি’না জানতে চাইলে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নুর-ই-আলম সিদ্দিকী শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, ১৪ আগস্ট অভিযোগ দিয়েছে আপনি বললেন, আমি ১৭ আগস্ট এই কর্মস্থলে যোগদান করেছি। আগামীকাল বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।
লিখিত অভিযোগের বিষয়ে ডিমলা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উক্ত নিয়োগ বোর্ডের প্রতিনিধি আব্দুল হালিম রংপুর আছি জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন। (উল্লেখ্য এই নিয়োগ বোর্ডে তিনিও উপস্থিতি ছিলেন।
জানতে চাইলে নীলফামারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ হাফিজুর রহমান শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, যদি বিষয়টি মাধ্যমিক স্কুলে হতো আমি এই বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতাম। যেহেতু মাদরাসার সেহেতু উপর থেকে তদন্তের নির্দেশ আসলে অবশ্যই আমি তদন্ত করব।
এলাকাবাসী কর্তৃক লিখিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করবেন কি’না জানতে চাইলে নীলফামারী জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) হাবিবুর রহমানকে না পেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে ডিজি স্যারের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লিখিত অভিযোগের বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে। অনিয়ম হলে কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করা হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৭/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.