অনিয়মে একাই একশো প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম, অপকর্মের সঙ্গী যারা!
আল আমিন হোসেন মৃধা, নির্বাহী সম্পাদকঃ রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে গেলেও স্কুল থেকে অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ এবং অনিবন্ধিত সুদে কারবারি করে হাতিয়ে নেওয়া মোটা অংকের টাকার মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের "ম্যানেজ" করে বার বার দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে এহেন কোন দপ্তর নেই যেখানে লিখিত অভিযোগ পাওয়া যাবে না। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, জেলা শিক্ষা অফিস এমনকি জেলা প্রশাসক বরাবরও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তোভুগী একাধিক অভিভাবকেরা (এর মধ্যে একজন শিক্ষকও আছেন)। এসব অভিযোগে একাধিকবার আর্থিক অনিয়মের প্রসঙ্গ উঠে আসলেও অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কোন শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি এই প্রধান শিক্ষককে। দেশভাগের বছর দুয়েক পরে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত উপজেলার অন্যতম স্বনামধন্য বিদ্যাপিঠটিতে ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
১৭ জুলাই, ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসক বরাবর আর্থিক অনিয়মের লিখিত অভিযোগ
প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন প্রতিষ্ঠানটির ১০৪ জন অভিভাবক। লিখিত অভিযোগে অভিভাবকেরা জানান, বিদ্যালয়ে যোগদান করার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষক। নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি গঠন না করে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে সভাপতি বানিয়ে এডহক কমিটি গঠন করে ইচ্ছেমত প্রতিষ্ঠানের অর্থ তছরুপ করেন তিনি। লিখিত অভিযোগে অভিভাবেকরা বলেন, বিদ্যালয়টির নিজস্ব জায়গায় দুইটি মোবাইল টাওয়ার রয়েছে (গ্রামীণ ও রবি)। এখান থেকে প্রতিমাসে টাকা আসে। বিদ্যালয়টির নিজস্ব মার্কেটে ১৫ টি দোকান আছে যেখান থেকে প্রতিমাসে ১৫ (২০১৮ সাল অনুযায়ী) হাজার টাকা ভাড়া আসে। যা বিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হয়। বিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় থাকলেও প্রধান শিক্ষক এডহক কমিটির যোগসাজসে নিয়ম বহির্ভুতভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তি ফি, বেতন, সেশস ফি সহ নানাবিধ ফির নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন। বিদ্যালয়টিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৮২ জন। শুধুমাত্র এক সাময়িকির পরীক্ষার ফি আদায় করেছেন ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। প্রতি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়ে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকেরা। আমরা এডহক কমিটি এবং প্রধান শিক্ষকের সাথে বার বার এই বিষয়ে কথা বলেও কোন সুরাহ করতে না পেরে আপনার নিকট (জেলা প্রশাসক) লিখিত অভিযোগ দিলাম।
এ বিষয়ে ১০৪ জন অভিযোগকারী অভিভাবকদের মধ্যে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আমরা তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোন ধরণের ব্যবস্থা না নেওয়া প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন আরও বেশি আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। কোন কিছুতেই কর্ণপাত করছেন না।
তারা আরও বলেন, প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন এর বিরুদ্ধে দিন যাচ্ছে আর অভিযোগের পাহাড় হচ্ছে। ২০১৮ সালে আমরা যখন অভিযোগ করেছিলাম যদি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে দিনের পর দিন এই অপকর্ম করতে পারতেন না। স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করতে তিনি একাই যথেষ্ট।
১০ আগস্ট, ২০২২ তারিখে টাকা না পেয়ে এক শিক্ষকের উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির কাগজ পত্র আটকে রাখেন প্রধান শিক্ষক
মোঃ আশরাফুল মন্ডল প্রতিষ্ঠানটির সহকারী শিক্ষক (বাংলা)। ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর ২য় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদান করেন। যোগদানের পর প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সকল বিধি মোতাবেক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। বিএড ডিগ্রি সম্পন্ন করলেও প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন এই শিক্ষকের কাছে অর্থ দাবি করে। অর্থ না দিলে বিএড স্কেল প্রাপ্তির কোন কাগজপত্র সরবারহ করবেন না বলে জানান। কোন উপায় না পেয়ে এই শিক্ষক তৎকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন।
লিখিত অভিযোগে এই শিক্ষক জানান, ২০ জুন, ২০২২ সালে লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মিনিস্ট্রি অডিট সম্পন্ন করে। অডিটকালে অডিটর আমার কাগজপত্র দেখে সন্তষ্ট প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন অডিটরের ব্যয় বাবদ আমার এক মাসের এমপিও'র (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) অর্থ দাবি করেন। পরবর্তীতে ২১ জুলাই ২০২২ তারিখে প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষক শফিকুল ইসলাম প্রধান শিক্ষকের কক্ষে আমাকে ডেকে প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয়ের হিসাবের খাতায় ৪৮০০ টাকা, ৪৫০০ টাকা এবং ৭০০ টাকা গ্রহণ করেছে মর্মে স্বাক্ষর প্রদানে মৌখিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমি সম্মতি না দেওয়ায় প্রধান শিক্ষক আমার বিএড স্কেল প্রাপ্তির কাগজপত্র আটকিয়ে দেন। এতে আমি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি এবং চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরে তৎকালীন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রোকসানা বেগমের হস্তক্ষেপে বিএড প্রাপ্তির প্রয়োজণীয় কাগজপত্র সরবারহ করতে বাধ্যহন প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন। একজন শিক্ষকের উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তির কাগজপত্র অর্থ না পেয়ে আটকে রাখলেও তার বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তখনও।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের অডিটকালে ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর কাছ থেকে জনপ্রতি এক মাসের এমপিও'র টাকা আদায় করেন প্রধান শিক্ষক
২০ জুন, ২০২২ সালে বিদ্যালয়টিতে অডিটে আসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের অডিট কর্মকর্তা মোঃ ফিরোজ হোসেন । অডিটকালে প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন একাধিক দুর্নীতি করায় ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়েন। অডিটে যাতে প্রতিষ্ঠান এবং তার বিরুদ্ধে কোন ধরণের প্রতিবেদন না আসে সেজন্য বিদ্যালয়ের ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রায় দুই লক্ষ টাকা (প্রতি শিক্ষকের এক মাসের এমপিও'র টাকা) উত্তোলন করেন অডিটরকে দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম এই টাকা না দেওয়ায় এবং তার বিএড স্কেল প্রাপ্তির কাগজপত্র আটকে রাখায় বিষয়টি সামনে আসে।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের আয় ব্যয়ের হিসাবের খাতায় প্রত্যেক শিক্ষকের স্বাক্ষর নেন প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম। স্বাক্ষর করেন যেন এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকরা মুখ খুলতে না পারেন।
বিষয়টি নিয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের অডিট কর্মকর্তা মোঃ ফিরোজ হোসেনের মুঠোফোনে বেশ কয়েকদিন ধরে একাধিক বার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরেও মেসেজ করলে তিনি সেটা দেখে কোন প্রত্যুত্তর করেননি।
বিষয়টি নিয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক টুটুল কুমার নাগ এর কাছে জানতে চাইলে, তিনি বিস্তারিত শুনে বিষয়টি নিয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর অলিউল্লাহ্ মোঃ আজমতগীর এর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। তবে প্রফেসর অলিউল্লাহ মোঃ আজমতগীর বৈঠকে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
২০২১ সালের এসএসসির পরীক্ষার ফরম পূরণে অব্যয়িত অর্থ ফেরত আসলেও সেটা আত্মসাৎ করেন প্রধান শিক্ষক
২০২১ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুধুমাত্র গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সব বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়ায় পরীক্ষা ব্যয় কমে। তাই পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণে আদায় করা টাকার অব্যয়িত অংশ ফেরত দেয় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডসহ সকল সাধারণ বোর্ড।
তবে শিক্ষা বোর্ড ফেরত দিলেও প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন সেই অর্থের এক টাকাও কোন শিক্ষার্থীকে ফেরত দেয়নি। সম্প্রতি শিক্ষাবার্তা'য় বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ পেলে প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত থাকায় সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বিদ্যালয়ের এসেম্বেলিতে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমাদের বাড়ীর আসেপাশে যদি কেউ ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী থাকে তাহলে তাদের বলবে সব পরীক্ষা না হওয়ায় ফরম পূরণের কিছু টাকা ফেরত পাবে। সেই টাকা স্কুলে এসে নিয়ে যেতে।
এ বিষয়ে দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা ২০২১ সালের এসএসসির ফরম পূরণের অব্যয়িত অংশ ফেরত পাঠানোর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে তারা বলছেন, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে কি'না সেটা দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার।
এ বিষয়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে সকল স্কুলের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। কেউ আত্মসাৎ করলে শিক্ষা দপ্তরকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেন তিনি।
২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করায় ইউএনও বরাবর অভিভাবকদের লিখিত অভিযোগ
চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীর ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগে প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন ও সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্তকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেয় অভিভাবকরা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে এই লিখিত অভিযোগ করেন বিদ্যালয়ের দশ জন অভিভাবক।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন এসএসসি বোর্ড পরীক্ষার ফরম পূরণ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য ৫০ শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে গত জানুয়ারীর মাসের ২১ ও ২২ তারিখে (শুক্রবার ও শনিবার) ডেকে নিয়ে জন প্রতি ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা আদায় করেছেন। যারা এই এ পরিমান অর্থ প্রদান করতে পারেননি তাদের ফরম পূরণের সুযোগও দেওয়া হয়নি।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন বদরগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ইউনিক আইডি ফি, ভর্তি ফি, মাসিক বেতন, এসাইনমেন্ট ও পরীক্ষার ফি কোন ধরনের অর্থ কমিটি ছাড়াই অর্থ আদায় ও উত্তোলন করে বিদ্যালয়ের কোন প্রকার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড না করে তা আত্মসাৎ করেছেন।
বিদ্যালয়টির এডহক কমিটির সভাপতি হাবিব লোহানী, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ শিক্ষাবার্তা'র কাছে ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার বিষয়টি এর আগে স্বীকার করেছেন। এ নিয়ে শিক্ষাবার্তা'য় সংবাদ প্রকাশ হলে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক এবং তার আর্থিক অনিয়মের সঙ্গী সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম অভিযোগকারী দুই অভিভাবক সাজ্জাদুল ইসলাম এবং আল আমিন কে মোটা অংকের অর্থের মাধ্যমে স্বাক্ষর নিয়ে এবং অন্যান্য অভিযোগকারীদের স্বাক্ষর জাল করে অতিরিক্ত অর্থ ফেরত পেয়েছে মর্মে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কার্যালয়ে জমা দেন। আর এক্ষেত্রে মধ্যস্ততাকারীর ভুমিকা পালনকারী হিসেবে কাজ করে লোহানী পাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ ডলু শাহ্। প্রধান শিক্ষক ডলু শাহকে বিদ্যালয়ের পরবর্তী কমিটিতে সভাপতি পদে বসানোর কথা বলে তাকে ব্যবহার করেন।
ইউএনও'র কার্যালয়ে অভিযোগ দেওয়ার পরে অভিযোগ পত্রের এক নম্বর স্বাক্ষরকারী সাজ্জাদুল মিয়া শিক্ষাবার্তা’কে বলেছিলেন, নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় কারও কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা কারও কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা আদায় করেছেন প্রধান শিক্ষক। যারা এই অর্থ দিতে রাজি হননি তাদেরকে ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়েই এই টাকা তাদের দিতে হয়েছে। অভিভাবকরা আরও বলেন, এখানকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবারের। মাসিক বেতন, এ ফি সে ফি দিতে গিয়ে তারা হিমসিম খাচ্ছেন।
অভিভাবক সাজ্জাদুল মিয়া শিক্ষাবার্তা’কে বলেছিলেন, আপনাদের সংবাদ প্রকাশের পর থেকেই আমাকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন প্রধান শিক্ষকের লোকজন। তারা বলছে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করেন না হলে সমস্যা আছে। কি সমাধান করতে বলছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ফরম পূরণে নেওয়া অতিরিক্ত টাকার দুই হাজার করে ফেরত নিয়ে স্বাক্ষর করতে বলেছেন। যদি তা না করি তাহলে সমস্যা আছে বলে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। কারা হুমকি দিচ্ছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হেলাল স্যার (মোঃ হেলাল হোসেন বদরগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) ফোন দিয়ে বদরগঞ্জে ডাকিয়েছেন আমি যায়নি। এছাড়াও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সেকেন্দার হোসেনের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন ও সাবেক ইউপি সদস্য বেলাল মন্ডল বিষয়টি সমাধান করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে হুমকি ধমকি দিচ্ছেন। এর বাইরেও চাপ দিচ্ছেন সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বাবা এই স্কুলেরই সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম। এখন আমি এবং অন্য অভিভাবকরা কি করব বুঝতেছি না।
প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদুলকে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে তাকে তার পক্ষে নিয়ে স্বাক্ষর করা এবং অন্যান্যদের স্বাক্ষর জাল করার পর শিক্ষাবার্তা'কে তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষক আমার কাছে এসে নত হয়ে এরকম কাজ আর করবে না মর্মে আমাকে বলেছিলেন। তাছাড়া তিনি ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত স্বাক্ষর না করলে যদি তার কোন ক্ষতি হয়ে যায় সেই দায়ভার আমার তাই আমি টাকা ফেরত নিয়ে স্বাক্ষর করেছি। তবে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি কারও স্বাক্ষর জাল করিনি সবাই আমার কাছে এসে স্বাক্ষর দিয়ে দুই হাজার করে টাকা ফেরত নিয়ে গেছে। শিক্ষাবার্তার পক্ষ থেকে দশজন অভিযোগকারীর অন্তত ছয় জ্নের সাথে যোগাযোগ করা হলে তা বলেছেন কোন কাগজে তারা স্বাক্ষর করেনি এবং কোন টাকা নেননি।
সাজ্জাদুল আরও বলেন, আমি, প্রধান শিক্ষক এবং লোহানী পাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে নিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কার্যালয়ে গিয়ে স্বীকারোক্তী দিয়ে আসছি টাকা ফেরত পেয়েছি মর্মে। ইউএনও'র কাছে লিখিত অভিযোগ প্রত্যাহার করতে গেলে তিনি বলেছেন অভিযোগ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে লোহানী পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ডলু শাহ'র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন। পরে ফোন করলে তিনি আর ধরেননি।
টানা পাঁচ বার এডহক কমিটি করে খেয়াল খুশিমত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন প্রধান শিক্ষক
প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন স্কুলটিতে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন রাখতে একাধিক বার একই ব্যক্তি হাবিব লোহানীকে এডহক কমিটির সভাপতি করে নিয়ে আসছেন। পূর্ণাঙ্গ ম্যানেজিংক কমিটি না করে বার বার এডহক কমিটি গঠিত হচ্ছে। কবে এই এডহক কমিট হয় কবে মেয়াদ শেষ হয় তা জানে না এলাকাবাসী । শিক্ষাবার্তার হাতে থাকা এডহক কমিটির সর্বশেষ চিঠি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর সর্বশেষ এডহক কমিটির জন্য দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করে প্রধান শিক্ষক। যা ০৯ নভেম্বর ২০২২ তারিখে অনুমোদন দেয় বোর্ড যার স্বারক নং ২/এস/৪০০/১০৫(০৬)। এই কমিটিতে মোঃ হাবীব মোশরেকী লোহানীকে সভাপতি,মোঃ মিঠু লোহানীকে অভিভাবক সদস্য এবং মোঃ আজিজুল হক কে শিক্ষক সদস্য করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল প্রধান শিক্ষক এডহক কমিটির জন্য যে আবেদন করে সেখানেও এই একই ব্যক্তিদের রাখা হয় এবং বোর্ড অনুমোদন দেয়। তার আগেও আরও তিন বার মিলিয়ে টানা পাঁচ বার এডহক কমিটি দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন তিনি। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আগামী মাসের ৯ তারিখে চলতি এডহক কমিটির মেয়াদ শেষ হবে। এরই মধ্যে বোর্ডে তদবির শুরু করেছেন প্রধান শিক্ষক। চলতি চার সদস্যের কমিটিকে পুনরায় এডহক কমিটি করার জন্য জোড় তদবির চালাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম।
বার বার কেন এডহক কমিটির অনুমোদন দিচ্ছে বোর্ড জানতে চাইলে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল শিক্ষা বার্তা'কে বলেন, যেহেতু কতবার এডহক কমিটি দেওয়া যাবে এরকম কোন সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা নেই। এটার ফায়দা নিচ্ছে অনেকে। এডহক কমিটি দেওয়া হয় মূলত নিয়মিত কমিটি করার জন্য। এটা দিতেই হয়। তবে ছয় মাসের মধ্যে নিয়মিত কমিটি না করে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজের মনোনীত প্রার্থীকে এডহক কমিটিতে আনছেন। চেয়ারম্যান স্যারের সুর্নিষ্ঠ নির্দেশে বার বার এডহক কমিটি কেউ চাইলে কেন এডহক কমিটির পুনরায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলো তার কারণ ব্যাখ্যা চাচ্ছি আমরা। এক কিংবা দুইবারের বেশি কোন প্রতিষ্ঠানে আমরা এডহক কমিটি এখন দিচ্ছি না। লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় পর পর পাঁচ বার এডহক কমিটির অনুমোদন নিয়েছে। এরপর ফের এডহক কমিটি নিতে আসলে আমরা দেব না সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা চাইব। প্রয়োজনে নোটিশ দিব।
তিনি আরও বলেন, দুইবারের বেশি কেউ এডহক কমিটি অনুমোদনের জন্য বোর্ডে পাঠালে আমরা একই ব্যক্তিকে ৩য় বার সভাপতি হিসেবে অনুমোদন আর দিব না। এ বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টের একটি ব্যাখ্যা আছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ
এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত ফি আদায় করায় ইউএনও'র কার্যালয়ে দেওয়া একই অভিযোগ দুদকের হট লাইন নম্বর "১০৬" এ ফোন করে অভিযোগ দেন অভিভাবকেরা। পরে দুদকের ইমেইলে অভিযোগের কপি দেওয়া হয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি।
এ বিষয়ে সাজ্জাদুল মিয়া জানিয়েছিলেন, আমরা দুদকের হটলাইন নম্বরে ফোন করলে তারা ইমেইল ঠিকানা দেন পরে আমরা সেই ইমেইলে অভিযোগ পাঠাই।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন,সমন্বিত জেলা কার্যালয়, রংপুরের উপ-পরিচালক আবু হেনা আশিকুর রহমান শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, বিষয়টি যেহেতু প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করেছে তারা বিষয়টি ভালো বলতে পারবে। প্রধান কার্যালয় থেকে আপনাদের কাছে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা আসছে কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, না আসে নাই। হেড অফিসের অভিযোগ হলেও বেশিরভাগ বিষয়গুলো ঢাকা থেকে আঞ্চলিক কার্যালয়ে আসে। এ বিষয় নিয়ে দুদকের জনসগযোগ বিভাগে কথা বলতে পারেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, গত ৬ ফেব্রুয়ারি এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ হটলাইন পরবর্তীতে ইমেইলে আসছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে যাচাই বাছাই করছি। একটু সময় লাগবে। সারাদেশ থেকে প্রচুর অভিযোগ আসে আমরা সেটা যাচাই করে কাজ শুরু করি। আশা করি অচিরেই এটা নিয়েও কাজ শুরু করতে পারব।
প্রধান শিক্ষক পদে মোয়াজ্জেম হোসেনের অবৈধ নিয়োগ
২০১২ সালে লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম অবসর নেন। অবসরের আগে তিনি জ্যেষ্ঠতার বিধি লঙ্ঘন করে তার ছেলে তৎকালীন সহকারী শিক্ষক শফিকুল ইসলামকে অবৈধ পন্থায় সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে যান। সেই দায়িত্ব থাকা অবস্থাতেই ২০১৪ সালে ভারপ্রাপ্ত/সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বর্তমান প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়োগ প্রদান করেন। এ নিয়োগেও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়টির তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন বেলাল মেম্বার। তিনি এবং শফিকুল ইসলাম দুইজনে মিলে দশ লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে মোয়াজ্জেন হোসেনকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তৎকালীন কমিটিরই একজন অভিভাবক সদস্য। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন একই উপজেলার পার্শ্ববর্তী রোস্তমাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক।
পিতার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পদের মত হাতে পাওয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের নিয়োগ অবৈধ প্রমাণিত হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ হারান শফিকুল ইসলাম। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার তদন্তে নিয়োগ অবৈধ প্রমাণিত হওয়ায় পদ হারিয়ে পূর্বের সহকারী শিক্ষক পদে ফিরতে হয় শফিকুল ইসলামকে। বিধিভেঙ্গে সহকারী এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার পরেও ২০১৪ সালের শেষ পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক পদে বেতন উত্তোলন করেননি তিনি। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের নিয়োগ অবৈধ হলেও তার নিয়োগ করা বর্তমান প্রধান শিক্ষক বহাল তবীয়তে থেকে যায়। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন শফিকুল ইসলামকে আবার সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন।
সনদ জালিয়াতি করে সহকারী শিক্ষক পদে মোয়াজ্জেম হোসেনের নিয়োগ
শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন রোস্তমাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাগজে কলমে যোগদান করেন ২০০৪ সালে। এবং প্রতিষ্ঠানটিতে আনুষ্ঠানিক যোগদান করেন ২০০৭ সালে। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) ২০০৫ সালে গঠিত হলে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধন সনদ থাকা বাধ্যতামুলক হওয়ায় মোয়াজ্জেম হোসেন ২০০৪ সালের নিয়োগ দেখিয়ে যোগদান করেন। শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই জালিয়াতি নয় তিনি করেছেন সনদ জালিয়াতিও। ১৯৯৪ সালে মোয়াজ্জেম হোসেন লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৬ সালে বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৯৯ সালে একই কলেজ থেকে ডিগ্রি (পাস) করেন। তবে মোয়াজ্জেম হোসেন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এসএসসি, এইচএসসি এবং ডিগ্রি তিন টাতেই ২য় বিভাগ দেখিয়েছেন। বাস্তবে ১৯৯৪ সালে লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ২য় বিভাগ পেলেও ১৯৯৬ সালে এইচএসএসি এবং ১৯৯৯ সালের ডিগ্রি (পাস) তে তিনি পেয়েছেন ৩য় শ্রেণী।
এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো ১৯৯৫ নীতিমালায় সুস্পষ্ট বিধান আছে, যে কোন বিষয়ের সহকারী শিক্ষক শিক্ষা জীবনের কোনটিতেই ৩য় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়। মোয়াজ্জেম হোসেন এর নিয়োগের জন্য দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতেও একই কথা উল্লেখ আছে। তবে মোয়াজ্জেম হোসেন এই তথ্য গোপন করে ২০০৭ সালে যোগদান করে ২০০৪ সালে নিয়োগ দেখিয়েছেন জাল সনদ তৈরি করে। তবে বিষয়টি অনেকেও জানলেও কেউ এই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি। শুধু জাল সনদ তৈরি করেই ক্ষ্যান্ত হননি এই শিক্ষক প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ বৈধ করতে নিয়োগ ও এমপিওভুক্তি দেখিয়েছেন ০১ মে, ২০০২ সালে। বাস্তবে তিনি ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিত যোগদান করলেও খাতা কলমে এমপিওভুক্তি হন ২০০৬ সালে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোস্তমাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তাহেরের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তার সংযোগ পাওয়া যায়নি এমনকি বিদ্যালয়ে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোয়াজ্জেম হোসেনের এসএসসির একই ব্যাচের এক ব্যক্তি বলেন, ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোয়াজ্জেম হোসেন কোন পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি তার এইচএসসি এবং ডিগ্রিতেও (পাস) ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
এত অনিয়ম করেও যেভাবে দায়মুক্তি পাচ্ছেন মোয়াজ্জেম হোসেন
একাধিক অভিভাবক ও এলাকাবাসীর জানান, লোহানীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন এত অপকর্ম করেও কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কি কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না এই কারণ অনুসন্ধানে নামে শিক্ষাবার্তা। প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনের আর্থিক অনিয়ম চাপা পড়ে যাওয়ার দুইটি কারণ অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে। প্রথমত বিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম করে এবং অনিবন্ধিত সুদে কারবারি হওয়ায় অনিয়ম ঢাকতে তিনি মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তা সমাধান করেন। দ্বিতীয়ত, মোয়াজ্জেম হোসেনের কাঁধে রয়েছে বদরগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলাল হোসেন। সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ করতে না পারায় এবং অতিরিক্ত অর্থ দাবি করায় স্কুলে অভিভাবকেরা বিক্ষোভ করলে প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন লোহানীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে নিজে বিষয়টি সমাধান করে দিয়ে যান এবং ফরম পূরণের ব্যবস্থা করেন। অভিযুক্ত মোয়াজ্জেম হোসেন নিজেও প্রধান শিক্ষক হেলাল হোসেন কাছের মানুষ বলে বিভিন্ন জায়গায় পরিচয় দিয়ে বেড়ায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেলাল হোসেন সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হলেও স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে তার। সেই প্রভাব খাটিয়ে গত ২৫ মে, ২০২২ তারিখে তার পূর্ব পরিচিত বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম শহিদুল ইসলামকে বদরগঞ্জ উপজেলায় বদলি করান। এস এম শহিদুল ইসলাম বদরগঞ্জ উপজেলায় বদলি হয়ে আসার পরেই মোয়াজ্জেম হোসেন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বদরগঞ্জ উপজেলায় আসার পর গত সাত মাসে প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে দুইটি লিখিত অভিযোগ ( ১০ আগস্ট, ২০২২ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) পেলেও তিনি তদন্ত করা তো দূরে থাক লোহানী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একবারের জন্যও পা ফেলেনি। মোয়াজ্জেম হোসেন যখনই কোন আর্থিক অনিয়মে সমালোচিত হয়েছেন তিনি ছুটে গেছেন মাধ্যমিকের এই শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। সম্প্রতি শিক্ষাবার্তায় এসএসসি ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার লিখিত অভিযোগ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে অভিযোগকারী দুই অভিভাবককে নিয়ে প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে লিখিত নেন এবং একই সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠেন।
তবে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করে এমনকি বিদ্যালয়ে গিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে সার্বিক বিষয়ে নিয়ে বদরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে যা বলছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা
রংপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ এনায়েত হোসেন শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, ইউএনও'র কাছে অনিয়মের যে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তোভুগিরা তার অনুলিপি আমার কাছে এসেছে। আমার কাছে যদি সরাসরি অভিযোগ করে তাহলে আমি বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। বিষয়টি নিয়ে আমি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে খোঁজ নিয়ে জানাতে বলেছি। সামগ্রিক বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের মিটিংটা এখনও হয়নি। মিটিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রংপুর কার্যালয় যা বলছে
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ পরিচালক শফিকুল ইসলাম শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, যে যে দপ্তরে এখন পর্যন্ত অভিযোগ করেছে তারা যদি কোন ব্যবস্থা বা তদন্ত না করে তাহলে অভিযোগটি আমার দপ্তরে দিতে বলেন। বিষয়টি আমি দেখব। যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন দপ্তর। আর আমি সবে মাত্র রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে যোগ দিয়েছি। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।
যা বলল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)
বিষয়টি অবহতি করলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এর মাধ্যমিক শাখার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন জানান, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিব। একজন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে একাধিক লিখিত অভিযোগ থাকলেও কোন ধরনের তদন্ত কেন হচ্ছে না বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে করা শিক্ষাবার্তার পূর্বের প্রতিবেদন পড়তে পারেন..
- এসএসসি ফরম পূরণে পাঁচ হাজার টাকা করে নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক
- শিক্ষাবার্তায় সংবাদ প্রকাশ: অভিভাবকদের প্রধান শিক্ষকের হুমকি
- বাসায় বসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করছেন প্রধান শিক্ষক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২০/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়