।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেল করলে সমাজের দৃষ্টি সাধারণত শিক্ষকের দিকেই যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—একজন শিক্ষার্থীর ব্যর্থতার দায় কি শুধু শিক্ষকের? নাকি শিক্ষার্থীর উদাসীনতা ও প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিও সমানভাবে দায়ী? শিক্ষার মান, পরিবেশ, পাঠদানের পদ্ধতি ও পরিবারিক সহায়তা—সব মিলিয়েই নির্ধারিত হয় একজন শিক্ষার্থীর ফলাফল। তাই দায় একক নয়, এটি একটি সমন্বিত ব্যবস্থার প্রতিফলন।
ইংরেজিতে একটি বহুল প্রচলিত উক্তি আছে—
“Education is not the filling of a pail, but the lighting of a fire.”
অর্থাৎ শিক্ষা মানে শুধু জ্ঞান ভরাট করা নয়, বরং চিন্তার আগুন প্রজ্জ্বলিত করা। একজন শিক্ষার্থীর সেই আগুন জ্বালাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যখন কোনো শিক্ষার্থীর রেজাল্ট খারাপ হয়, তখন দায়ভার কার? শিক্ষক, শিক্ষার্থী, নাকি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা?
এই প্রশ্নের সরল উত্তর নেই। কারণ শিক্ষা একটি যৌথ প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং প্রতিষ্ঠান—সবাই সমানভাবে যুক্ত। একজনের ত্রুটি অন্যের সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
শিক্ষক শিক্ষার মেরুদণ্ড—এই কথা প্রায়ই বলা হয়। শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, বরং শিক্ষার্থীর নৈতিকতা, চিন্তাশক্তি ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা রাখেন। একজন ভালো শিক্ষক শিক্ষার্থীর কৌতূহল জাগিয়ে তোলেন, শেখার আগ্রহ বাড়ান এবং তাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “একজন শিক্ষকের মূল দায়িত্ব হলো প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজন বুঝে পাঠদান করা। সবাইকে এক চোখে দেখা শিক্ষা নয়, বরং এটি একটি মানসিক প্রক্রিয়া।”
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। দেশের অনেক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী পড়াতে হয়। এই অবস্থায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতি আলাদা মনোযোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে কিছু শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষক আন্তরিক হলেও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা তার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেয়।
ইউনিসেফ রিপোর্ট (২০২৩) অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষার মান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং দুর্বল শিক্ষার পরিবেশ। অনেক শিক্ষক এখনো আধুনিক পদ্ধতিতে পাঠদান শেখেননি। এতে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারায় এবং ফলাফল খারাপ হয়।
শিক্ষক যতই পরিশ্রম করুন, শিক্ষার্থীর নিজের আগ্রহ ও অধ্যবসায় না থাকলে ভালো ফলাফল সম্ভব নয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—পড়াশোনায় অনীহা, মোবাইল ও সামাজিক মাধ্যমের আসক্তি, নিয়মিত অধ্যয়নের অভাব,ও পরীক্ষার ভয়।
মনোবিজ্ঞানী ড. রেশমা চৌধুরী বলেন, “শিক্ষককে দোষারোপ করা সহজ, কিন্তু শিক্ষার্থীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্ববোধ না থাকলে কোনো শিক্ষকই তাকে সফল করতে পারবেন না।”
এছাড়া মানসিক চাপ, পারিবারিক সমস্যা বা স্বাস্থ্যগত দুর্বলতাও শিক্ষার্থীর মনোযোগ নষ্ট করে। বিশেষ করে শহুরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষার ভয় এত বেশি যে তারা পড়াশোনার আনন্দ হারিয়ে ফেলে। ফলে ফলাফলেও তার প্রভাব পড়ে।
শিক্ষা শুধু স্কুলের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। পরিবার একটি শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। কিন্তু অনেক অভিভাবক শিক্ষার প্রতি সচেতন নন। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলেন। আবার অনেক পরিবারে দেখা যায়, শিশু নিজে পড়াশোনা করছে, কিন্তু পাশে বসে তাকে উৎসাহ দেয়ার মতো কেউ নেই।
অন্যদিকে, নিম্নআয়ের পরিবারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনও একটি বড় বাধা। শিশুকে অনেক সময় ছোটবেলায়ই কাজ করতে হয় বা স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে। ফলে তারা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে এবং রেজাল্ট খারাপ হয়।
একটি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, অবকাঠামো, শিক্ষাসামগ্রী এবং নীতিমালা—সবকিছুই শিক্ষার্থীর ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে এখনো অনেক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষাসামগ্রী বা টয়লেট সুবিধা নেই। গ্রামীণ এলাকার অনেক স্কুলে শিক্ষক ঘাটতি প্রকট। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা শিক্ষার্থীর তুলনায় অপর্যাপ্ত।
এই বাস্তবতায়, শিক্ষক আন্তরিক হলেও শিক্ষাদানের মান বজায় রাখা কঠিন। অনেক সময় প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং নির্ভর সংস্কৃতি শিক্ষার মৌলিক কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলেছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠান তার মৌলিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
বাংলাদেশে ২০২১ সালের জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ অনুযায়ী—
৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১.৭% কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বসবাস করছে।
৬৫% শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও,
৩৫% মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছায় না।
আর মোট ৬০% প্রতিবন্ধী শিশু এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অংশ নেয়নি।
এই শিক্ষার্থীরা সাধারণ শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা করতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। শিক্ষক যদি তাদের সমস্যাগুলো বুঝে উপযুক্ত সহায়তা না দেন, তবে তারা পিছিয়ে পড়ে। ফলে ফলাফল খারাপ হয়। এখানে দায় একক নয়—এটি শিক্ষক, অভিভাবক এবং প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ব্যর্থতা।
প্রযুক্তির এই যুগে জ্ঞানের উৎস আর শুধু শিক্ষক নন। এখন শিক্ষার্থীরা ইউটিউব, অনলাইন কোর্স বা গুগলের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ফলে শিক্ষকের ভূমিকা বদলে গেছে। এখন তিনি কেবল তথ্য প্রদানকারী নন, বরং একজন গাইড, মেন্টর ও চিন্তার অনুপ্রেরণাকারী।
শিক্ষাবিদ ড. সাঈদা ইসলাম বলেন, “শিক্ষকের কাজ এখন শুধুমাত্র পাঠ্য জ্ঞান দেওয়া নয়, বরং শিক্ষার্থীর ভাবনা, বিশ্লেষণ এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা।”
অন্যদিকে, প্রয়াত শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, “শিক্ষকের আন্তরিকতা ও মানবিকতা না থাকলে শিক্ষার্থী শেখার আগ্রহ হারায়। তবে পরিবার ও সমাজও শিক্ষার্থীর মান উন্নয়নে সমানভং
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনো ‘মুখস্থ বিদ্যা’কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্ব আজ বিশ্লেষণ, যুক্তি এবং সৃজনশীলতার যুগে প্রবেশ করেছে। এই ব্যবধান পূরণ করতে না পারলে রেজাল্ট উন্নতি অসম্ভব।
আলভিন টফলার বলেছেন,“The illiterate of the 21st century will not be those who cannot read and write, but those who cannot learn, unlearn, and relearn.”
অর্থাৎ, এখন নিরক্ষর মানে শুধু অশিক্ষিত নয়, বরং তারা যারা নতুন কিছু শিখতে, পুরনো ভুলে যেতে এবং নতুনভাবে শেখার সাহস রাখে না।
এই কথাটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে প্রযোজ্য। শিক্ষার্থীকে শুধু তথ্য নয়, চিন্তা শেখাত
একজন শিক্ষার্থীর রেজাল্ট ভালো করতে হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র—সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি, প্রযুক্তি ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৫-৩০ এর মধ্যে রাখলে শিক্ষক প্রত্যেকের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
প্রতি মাসে অভিভাবক বৈঠক আয়োজন করে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি আলোচনা করা।
শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা বা উদ্বেগ মোকাবিলায় স্কুলে নিয়মিত কাউন্সেলিং ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, স্মার্ট বোর্ড ও অনলাইন লার্নিং ব্যবহার করে শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করা।
প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও উপযুক্ত উপকরণ প্রদান করে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।
রেজাল্ট খারাপ হওয়া মানেই শিক্ষক ব্যর্থ—এই ধারণা একপেশে এবং বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গত।
একজন শিক্ষার্থীর ভালো বা খারাপ ফলাফল হলো সমষ্টিগত প্রচেষ্টার প্রতিফলন। শিক্ষক পথ দেখান, শিক্ষার্থী নিজে হাঁটে, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান তাকে সহায়তা করে।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থই বলেছেন—“একজন শিক্ষার্থী ব্যর্থ হলে শুধুমাত্র শিক্ষককে দায়ী করা অন্যায়; এটি একটি সম্মিলিত ব্যবস্থার ব্যর্থতা।”কখ
অতএব, দোষারোপ নয়—প্রয়োজন সমন্বয়। শিক্ষার মূল লক্ষ্য শুধু ভালো রেজাল্ট নয়, বরং একজন সচেতন, মানবিক ও চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করা। সেই লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান—সবারই একসঙ্গে চলতে হবে।
লেখা: শিক্ষক ও গবেষক।
শিক্ষাবার্তা /এ/০৭/১০/২০২৫
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
শিক্ষাবার্তা ডট কম অনলাইন নিউজ পোর্টাল
