এইমাত্র পাওয়া

রোজা রাখলে শরীরের ওজন কমে না, পাপের ওজন কমে

।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।। 

রোজা হলো এমন এক ইবাদত, যা দেহকে ক্ষুধার্ত করে কিন্তু আত্মাকে তৃপ্ত করে।
এটি শরীরের নয়, মন ও আত্মার চিকিৎসা—যার লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পাপমোচন।

রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পরহেজগার ও আল্লাহভীরু বানানো। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে রোজা রাখলে শরীরের নয়, বরং আত্মার ভার লাঘব হয়; কমে পাপের ওজন, বাড়ে তাকওয়ার ওজন।

কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—“হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা পরহেজগার (তাকওয়া) অর্জন করো।”(সূরা আল-বাকারা ২:১৮৩)

এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—রোজার উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া, অর্থাৎ আল্লাহভীতি ও আত্মসংযম অর্জন। তাকওয়া এমন এক গুণ, যা মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে, অন্যায়কে ঘৃণা করতে শেখায়। যখন মানুষ আল্লাহকে ভয় করে, তখন সে গোপনেও পাপ করে না।

রোজা সেই ভয় ও সংযমের চর্চা শেখায়—যেখানে কেউ দেখছে না, তবুও একজন মুমিন খায় না, পান করে না, কারণ সে জানে—“আমার রব দেখছেন।” এই অন্তর্নিহিত সচেতনতার নামই তাকওয়া।

রোজা মানুষকে শেখায় কীভাবে নিজের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রাগ, কাম—সবই মানবজীবনের স্বাভাবিক অনুভূতি। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তি এসব প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরে রাখে। এই আত্মসংযমই রোজার সবচেয়ে বড় শিক্ষা।আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন— “রোজা হলো ঢাল; এটি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে।”(সহিহ বুখারি)

ঢাল মানে প্রতিরক্ষা। অর্থাৎ রোজা মানুষকে পাপ ও শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করে। তাই বলা যায়—রোজা আত্মার রক্ষা-ঢাল, পাপ কমানোর কার্যকর ওষুধ।

নবী করিম (সা.) বলেন— “যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মসমর্পণের সঙ্গে রোজা রাখে, তার পূর্বের গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়।”(বুখারি ও মুসলিম)

এই হাদিসে বোঝানো হয়েছে—রোজা কোনো দেহিক অনুশীলন নয়, বরং আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যম। কিন্তু শর্ত হলো—রোজা রাখতে হবে ঈমান ও নিয়তের সঙ্গে, কেবল ক্ষুধা সহ্য করার জন্য নয়।আরেক হাদিসে রাসুল সা: সতর্ক করেছেন— “অনেক রোজাদার আছে, যাদের রোজা থেকে লাভ শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা।”(ইবনে মাজাহ)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা বলে, পাপ করে, অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে—তার রোজা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রকৃত রোজা সেই, যা মানুষের অন্তরকে পবিত্র করে, আচরণকে সুন্দর করে, এবং পাপ থেকে দূরে রাখে।

আজকের দুনিয়ায় অনেকেই “ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং” বা “ডিটক্স ডায়েট” হিসেবে উপবাস করে শরীরের ওজন কমাতে চান। কিন্তু ইসলামী রোজা তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামে রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো ইবাদত ও আত্মশুদ্ধি, কোনো শারীরিক পরীক্ষা নয়।

ডায়েট বা ফাস্টিং শরীরের চর্বি কমাতে পারে, কিন্তু রোজা কমায় অহংকার, পাপ, রাগ ও লোভের ওজন।
ইসলামী রোজায় “নিয়ত” হলো মূল। যদি নিয়ত শুধু দেহের ওজন কমানো হয়, তাহলে তা ইবাদত নয়; কিন্তু যদি নিয়ত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তবে রোজার প্রতিটি মুহূর্ত সওয়াবের খনি হয়ে যায়।

রোজা শুধু ব্যক্তিগত নয়, এর সামাজিক দিকও গভীর। রোজার মাধ্যমে ধনী ব্যক্তি ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করে গরিবের দুঃখ বুঝতে শেখে। ফলে সমাজে দান, সহানুভূতি, ও মানবিকতা বৃদ্ধি পায়।

রমজান মাসে জাকাত ও সদকা আদায় করা শুধু আর্থিক লেনদেন নয়, বরং সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার এক মহান উদ্যোগ। রোজা মানুষকে শেখায়—নিজের প্রাপ্তি নয়, অন্যের অভাবও বিবেচনা করতে হবে। এভাবে রোজা সমাজে সহমর্মিতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে।

রোজা হলো আত্মার চিকিৎসা। আমরা প্রতিদিন যত পাপ করি, যত দোষ জমাই—তা আত্মাকে ভারী করে তোলে। রোজা সেই ভার লাঘবের এক অনন্য পথ। যখন কেউ রোজা রাখে, তখন সে শুধু খাওয়া–দাওয়া থেকে বিরত থাকে না; তার চোখ, কান, জিহ্বা, মন—সব অঙ্গকেও সংযত রাখে।

রাসুল (সা.) বলেছেন—“যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও তা অনুযায়ী কাজ পরিত্যাগ করে না, আল্লাহর তার খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।”(সহিহ বুখারি)

অর্থাৎ রোজা তখনই মূল্যবান, যখন তা মানুষের চরিত্রে পরিবর্তন আনে, জিহ্বাকে মিথ্যা থেকে, চোখকে হারাম থেকে, আর মনকে অহংকার থেকে মুক্ত করে।

রোজা রাখলে শরীর হালকা হয়—এটা সত্য, কিন্তু ইসলামীভাবে তার চেয়েও বড় সত্য হলো, রোজা রাখলে পাপের বোঝা হালকা হয়। রোজা মানুষকে আল্লাহর কাছে নম্র করে, পাপ থেকে দূরে রাখে, আর তওবা করতে উদ্বুদ্ধ করে।

একজন প্রকৃত রোজাদার দিনশেষে শুধু ক্ষুধার্ত নয়—সে আত্মায় তৃপ্ত, কারণ সে জানে তার রব তাকে দেখছেন, শুনছেন, আর তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে রেখেছেন।

রোজা মানুষকে নিজের ভুল, অন্যের প্রতি অন্যায়, ও আল্লাহর অবাধ্যতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। তাই রোজার শেষে শুধু শরীর নয়, মনও হয় পবিত্র, আত্মা হয় হালকা।

আল্লাহ বলেন— “রোজা আমার জন্য, এবং আমিই এর প্রতিদান দেব।”(সহিহ বুখারি)

এটি ইবাদতের মধ্যে রোজার বিশেষ মর্যাদা নির্দেশ করে। আল্লাহ নিজে বলেছেন, তিনি রোজাদারকে ভালোবাসেন, কারণ রোজাদার একান্তভাবে তাঁর জন্যই রোজা রাখে। এ ভালোবাসা লাভের চেয়ে বড় কোনো পুরস্কার নেই।

রোজা মানুষকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যায়। যখন মানুষ রোজার মাধ্যমে পাপ থেকে দূরে থাকে, তখন আল্লাহ তার অন্তরে শান্তি ও প্রশান্তি দান করেন। এই প্রশান্তিই রোজার প্রকৃত “ওজন হ্রাস”—যেখানে আত্মা পাপের ভারমুক্ত হয়ে আলোর দিকে ফিরে যায়।

রোজা শরীরের ওজন কমানোর উপায় নয়; বরং এটি আত্মার ওজন হ্রাসের পদ্ধতি। এটি এমন এক ইবাদত, যা মানুষকে অহংকার থেকে বিনয়, পাপ থেকে পবিত্রতা, লোভ থেকে তৃপ্তির দিকে নিয়ে যায়।

রোজার মাধ্যমে মানুষ শেখে—সংযমই জীবনের সৌন্দর্য। আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসাই প্রকৃত ওজনের ভারসাম্য। তাই বলা যায়— “রোজা রাখলে শরীরের ওজন কমে না, কমে পাপের ওজন; হালকা হয় আত্মা, ভারমুক্ত হয় মন।”

লেখা: শিক্ষক ও গবেষক। 

শিক্ষাবার্তা /এ/০৭/১৯/২০২৫

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading