এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষক মানেই আন্দোলন, এ কেমন রাষ্ট্রব্যবস্থা?

।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।। 

“যে জাতি শিক্ষকের মর্যাদা দিতে জানে না, সে জাতি কখনোই আলোকিত হতে পারে না”—এই চিরন্তন সত্য কথাটি আজও প্রাসঙ্গিক, বরং আগের চেয়ে আরও বেশি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে শিক্ষকতা এখন যেন এক বঞ্চনার প্রতীক, অবহেলার প্রতিচ্ছবি। এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে শিক্ষক হওয়া মানে আন্দোলনের মাঠে নামা, প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানো, দাবি-দাওয়া নিয়ে পথে নেমে নিজের ন্যায্য অধিকার আদায় করা। প্রশ্ন জাগে—যাদের হাতে জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের বারবার রাস্তায় নামতে হয় কেন? শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তবে এই মেরুদণ্ডটিই বারবার ভাঙা অবস্থায় কেন পড়ে থাকে?

একজন শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর। তিনিই গড়ে তোলেন আগামী দিনের চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রশাসক, সেনা কর্মকর্তা কিংবা নীতিনির্ধারক। অথচ সেই শিক্ষকই সবচেয়ে বঞ্চিত। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যের এমন বিশাল ফারাক পৃথিবীর খুব কম দেশেই দেখা যায়। বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকাংশই এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, কিন্তু তাদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা, পেনশন, চিকিৎসা বা অবসরকালীন সুবিধা সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় অতি নগণ্য। একই শ্রেণিতে একই পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পাঠদান করেও দুইজন শিক্ষক দুই রকম সুযোগ সুবিধা পান—এ কেমন বিচার?

একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে একজন শিক্ষক পান সরকারি বেতন, চিকিৎসা ভাতা ও অবসর সুবিধা, অন্যজন পান কেবল ন্যূনতম ভাতা, তাও অনিয়মিত। অথচ কর্মপরিধি ও দায়িত্ব একদম সমান। এটি কেবল বৈষম্য নয়, এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অবিচার।

বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি নতুন নয়। এই দাবিতে তারা গত কয়েক দশকে অসংখ্যবার আন্দোলন করেছেন—মাঠে, ময়দানে, সড়কে, এমনকি শিক্ষাদান বন্ধ রেখে রাজপথে অনশন পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গও হয়েছে। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা শিক্ষকদের দাবি শোনেন, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেন না। ফলে শিক্ষকদের আর কোনো পথ খোলা থাকে না—আবারও আন্দোলন, আবারও প্রতিবাদ। যেন শিক্ষকের পরিচয়ের সঙ্গে আন্দোলন শব্দটি চিরস্থায়ীভাবে জুড়ে গেছে।

বস্তুত, এই ঘুরেফিরে আন্দোলন চালানোর সংস্কৃতি শুধু শিক্ষকদের জন্য অপমানজনক নয়, রাষ্ট্রের জন্যও লজ্জাজনক। কারণ, শিক্ষকরা কোনো রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আন্দোলন করেন না; তারা লড়েন নিজেদের ন্যায্য অধিকারের জন্য—যা রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের আগেই নিশ্চিত করার কথা ছিল।

প্রতিবার যখন শিক্ষকরা রাজপথে নামেন, তখন সমাজের একাংশ তাদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করে—“আবার শিক্ষকরা রাস্তায় নেমেছে!” অথচ ভাবা উচিত, যে মানুষটি সারাজীবন শিক্ষার্থীদের মানুষ বানাতে জীবন উৎসর্গ করেন, তিনি রাস্তায় নামতে বাধ্য হন কেন? তাঁর কি কোনো বিকল্প আছে? সংসারের চাপে, সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায়, কিংবা চিকিৎসার অভাবে যখন জীবন জর্জরিত, তখন শিক্ষকও তো মানুষ—তাকেও বাঁচতে হয়। রাষ্ট্র যদি তাঁকে সেই ন্যূনতম নিশ্চয়তা না দেয়, তাহলে তিনি মুখ খুলবেন না কেন?

এই নৈতিক জাগরণ আমাদের সমাজে অনুপস্থিত। শিক্ষককে আমরা শ্রদ্ধা করি মুখে, কিন্তু তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত করতে বাস্তবে কিছুই করি না। সরকারি কর্মকর্তার গাড়ি বদলে যায় প্রতি বছর, কিন্তু শিক্ষক এখনও সাইকেলে বা বাসে গাদাগাদি করে স্কুলে যান—এই বৈষম্য আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না।

প্রতিটি সরকারই ক্ষমতায় এসে বলে, “শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে, শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক করা হবে।” কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশেরও কম। সরকারি চাকরিতে মাইনের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় ইনক্রিমেন্ট হয়, কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের সেই সুযোগ নেই। জাতীয়করণের প্রশ্নে সরকার এক অদ্ভুত দ্বিধায় ভোগে—একদিকে তারা জানে, শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক; অন্যদিকে ‘অর্থনৈতিক চাপ’ দেখিয়ে বছর পার করে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—জাতির মেরুদণ্ড শক্ত না করে উন্নয়ন টেকসই হবে কীভাবে?

রাষ্ট্র যদি হাজার হাজার কোটি টাকা অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করতে পারে, তাহলে শিক্ষকদের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করতে পারবে না কেন? রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বিল্ডিং নির্মাণ হয়; কিন্তু মানবসম্পদ গঠনের মূল চালিকাশক্তি—শিক্ষকদের জীবনে আলো জ্বালাতে কোনো উদ্যোগ নেই। এটি নিছক প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি এক প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতা।

যখন একজন শিক্ষক রাজপথে দাঁড়ান, তখন সেটা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত বঞ্চনার প্রতীক নয়, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। কারণ, শিক্ষককে যদি আন্দোলনে নামতে হয়, তাহলে বোঝা যায়—রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি কোথাও গুরুতরভাবে ব্যর্থ। শিক্ষকদের সঙ্গে বৈষম্য রেখে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হতে পারে না।
জাতীয়করণ শুধু বেতন কাঠামোর প্রশ্ন নয়; এটি শিক্ষার মান, স্থায়িত্ব ও ন্যায্যতার প্রশ্ন। শিক্ষকের নিশ্চয়তা মানে শিক্ষার নিশ্চয়তা, আর শিক্ষার নিশ্চয়তা মানে জাতির ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।

আজকের সমাজে শিক্ষকতা পেশা নয়, বরং এক ধরনের আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক শিক্ষক দীর্ঘদিন বেতন পান না, কেউ পেনশন পান না, আবার কেউ সামান্য সম্মানীর আশায় পরিবার চালান। অথচ তাঁরই ছাত্র বিদেশে গিয়ে কোটি টাকার চাকরি করেন, রাষ্ট্রের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু সেই শিক্ষকের ঘরে এখনও কেরোসিনের আলো, টিনের ঘর, ঋণের বোঝা। এই চিত্র শুধু বেদনাদায়ক নয়, এটি এক জাতির আত্মপরিচয়ের ওপর প্রশ্ন তোলে।

প্রতিবার শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন, রাষ্ট্র আশ্বাস দেয়—“বিষয়টি বিবেচনাধীন।” কিন্তু বছর যায়, দশক যায়, কিছুই হয় না। এখন সময় এসেছে আশ্বাস নয়, কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ শুধু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়, এটি সময়ের দাবি। কারণ, শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষককে মর্যাদা দিতে হবে, তাঁর জীবনমান উন্নত করতে হবে। ক্ষুধার্ত শিক্ষক কখনোই সৃষ্টিশীল প্রজন্ম গড়তে পারেন না।

রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে—শিক্ষক মানেই আন্দোলন নয়; শিক্ষক মানে প্রেরণা, নেতৃত্ব ও মানবিকতার প্রতীক। তাই শিক্ষকদের বারবার রাজপথে নামতে বাধ্য করা রাষ্ট্রের জন্য এক কলঙ্ক। এখন সময় এসেছে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার।
সরকারের উচিত দ্রুত বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়সীমাবদ্ধ রোডম্যাপ ঘোষণা করা। পাশাপাশি বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, চিকিৎসা সুবিধা, পেনশন ও বাড়িভাড়া ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকরা যদি নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারেন, তাহলে শিক্ষার্থীরাও নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করবে—এটাই প্রকৃত উন্নয়নের পথ।

একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে প্রবেশ করেন, তখন তিনি কেবল পাঠদান করেন না; তিনি জাতিকে গড়ে তোলেন। অথচ এই মহান মানুষটিই যখন প্রতিবাদে রাজপথে দাঁড়াতে বাধ্য হন, তখন সেটি কেবল একটি পেশার নয়, একটি জাতির ব্যর্থতার প্রতীক।

শিক্ষক মানেই আন্দোলন—এই তিক্ত বাস্তবতার অবসান ঘটাতে হবে এখনই। কারণ, যে রাষ্ট্র শিক্ষকদের সম্মান দিতে জানে না, সে রাষ্ট্রের উন্নয়ন যতই হোক, সেটি কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন যেন আর না হয়—এই দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কারণ, শিক্ষকরা রাস্তায় নয়, শ্রেণিকক্ষেই সবচেয়ে বেশি মানানসই।

লেখা: শিক্ষক ও গবেষক। 

শিক্ষাবার্তা /এ/০৭/১০/২০২৫

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading