চট্টগ্রামঃ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে নতুন করে সাজাতে হবে। মেডিকেল কলেজগুলোতে চিকিৎসক, নার্স ও দক্ষ কর্মচারীর সংকট রয়েছে। প্রয়োজন অনুপাতে ভবন নেই, যন্ত্রপাতি নেই। হাসপাতালে শয্যা নেই। মেঝেতে, শৌচাগারের সামনেও রোগীদের থাকতে হচ্ছে। এসব সংকট কাটাতে যে বাজেট দরকার, সেটিও নেই। তাই বাজেট অন্তত তিন গুণ বাড়াতে হবে। আজ শনিবার সকালে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব সংকট তুলে ধরেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মিলনায়তনে এ সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। এ ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক সায়েবা আক্তার, মো. মোজাহেরুল হক, আজহারুল ইসলাম খান ও উমাইর আফিফ। সভার সঞ্চালনা করেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন। সভায় স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সংকট ও ভবিষ্যৎ করণীয় তুলে ধরেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নার্স, কর্মচারী, স্বাস্থ্যকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীরা।
শুরুতে মতবিনিময় সভা আয়োজনের উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়। কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, সরকার গঠিত এ কমিশনের কাজ এ খাতে পলিসি তৈরিতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। মতবিনিময় সভায় পাওয়া পরামর্শগুলো পরবর্তী সময়ে কমিশনের প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যবহার করা হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যের পর কমিশনের সদস্যরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, বর্তমানে যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে, সেটি নতুন করে সাজানো উচিত। স্বাস্থ্য সবার অধিকার। এই ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে। জনগণ কী চায়, এ বিষয়ে সবার মতামত নিয়ে কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও সুসংগঠিত ও উন্নত মানের করতে কমিশন কাজ করবে।
যা উঠে এল আলোচনায়
সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাজেট দ্বিগুণ বা তিন গুণ করার কথা বলেছেন। আসলেই তা–ই। এ খাতে বাজেট অন্তত তিন গুণ বাড়াতে হবে। যেসব দেশে পকেট থেকে টাকা খরচ করে স্বাস্থ্যসেবা সরাসরি কেনা হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা সমন্বিত, সুসংগঠিত এবং সরকারিভাবে সর্বজনীন হতে হবে। এটি না হলে মানুষ উচ্চ দামে কম মানসম্মত বেসরকারি সেবা কিনবে। যেটি আমরা কিনছি।’
এম এ ফয়েজ বেশ কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে শহর-নগর ভেদে প্রতিটি জনগণের জন্য কেবল স্বীকৃত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে পরামর্শ দেওয়া, বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার বাইরে অন্য কোনো পদ্ধতি না রাখা, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থাসহ জরুরি রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের ব্যবস্থা করা, গুণগত মানের ল্যাব স্থাপন, রেডিওলজি ও ফার্মাসির ব্যবস্থা রাখা, ভর্তিযোগ্য রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে না রাখা ইত্যাদি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদ হোসেন বলেন, মেডিকেল শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। আবাসন বরাদ্দেও নীতিমালা দরকার। প্রয়োজনে লটারির মাধ্যমে আসন বরাদ্দ দিতে হবে। হলে সব ধরনের র্যাগিং বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থী অনুপাতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
সভায় গবেষক ও অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ দরকার। পাশাপাশি কলোনিয়াল লিগ্যাসি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদিও এখানে আমলাতান্ত্রিক, করপোরেট ও রাজনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে একটা জাল তৈরি করা হয়েছে। করোনা মহামারি কিংবা ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমরা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারতাম। কিন্তু গবেষণার বরাদ্দ এখানে বড় বিষয়।’
স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানো ছাড়া কোনো সংস্কার হবে না বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি অ্যাপোলো ইম্পিরিয়াল হসপিটালের ল্যাবরেটরি মেডিসিনের প্রধান অধ্যাপক মো. আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাজেটের অন্তত ১১ শতাংশ। আমাদের দেশে বরাদ্দ মাত্র ৫ শতাংশ।
প্রাইভেট ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল মোতালেব বলেন, জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ তৈরি করা হচ্ছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাহিদা অনুপাতে শিক্ষক কি আছে? প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কি আছে?
সভায় রোগী বা রোগীর কোনো স্বজন না থাকায় প্রশ্ন তোলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘যাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, সেই রোগী বা রোগীর কোনো স্বজন এ সভায় নেই। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন নাম হলেও মনে হচ্ছে এটি মেডিকেল শিক্ষা সংস্কার কমিশন। যে যাঁর স্বার্থ নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু যিনি সেবা নিচ্ছেন, তাঁদের কোনো কথা কারও বক্তব্যে উঠে আসেনি। তাই অনুরোধ থাকবে, পরবর্তী সভাগুলোতে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে যেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’
জসিম উদ্দিনও সংস্কারে একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আন্দোলন চলাকালে অনেক চিকিৎসক সেবা দিতে চাননি। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণ করা হয়। একটার সঙ্গে আরেকটির মিল নেই। এ ছাড়া হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এসব বন্ধ করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ আরও বাড়াতে হবে।
সভায় আরও বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ওমর ফারুক মো. ইউসুফ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. জসিম উদ্দিন, চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২১/১২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.