এইমাত্র পাওয়া

সৃজনশীলভাবে দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী নয় অনেকেই

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ: টারশিয়ারি সেক্টর বলতে সচরাচর সেবা খাতকে বোঝানো হয়। দেশে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চশিক্ষার সুযোগও কম নয়। বরং বলা যায়, দেশে টারশিয়ারি গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সাক্ষর তরুণ শতকরা ২৫০ হারে বেড়েছে; যা দেশে বিদ্যমান শিল্প খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এ সাক্ষর তরুণের সিংহভাগই বেকারত্বের শিকার। টারশিয়ারি সেক্টরের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা পাওয়ার পরও এ তরুণরা চাকরির বাজারের চাহিদার অনুপাতে দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তা ছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না আর তা হলেও উচ্চশিক্ষার অভিমানে অনেকেই কিছু কিছু চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ পাচ্ছেন না। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বেকারত্বের মতো জটিল ও ক্লান্তিকর সামাজিক সমস্যা নিরসন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উন্নয়নশীল অর্থনীতি গতিশীল করতে হলে শ্রমের সুষ্ঠু বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হয়। সস্তা শ্রম দেশে সহজলভ্য।

কিন্তু দেশের বিশাল একটি অংশ উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর বুদ্ধিবৃত্তিক বা টারশিয়ারি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে থাকে। কিন্তু এ খাতে পর্যাপ্ত নিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না প্রশাসনিক জটিলতার কারণে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিসিএস বাদেও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ৪ লাখের বেশি শূন্যপদ রয়েছে। এ সংখ্যা পূরণ করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তরিক ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত বরাবরই দিয়ে আসছে। কিন্তু বেকারত্বের মতো সমস্যার অবস্থা হালনাগাদ না করলে মূল সমস্যার সমাধান কোনো দিনই অর্জন করা সম্ভব হবে না। মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদে জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হয় যা পরবর্তীতে সরকার পতনের অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। দেশের শিক্ষিত তরুণরা বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক মন্দার সংকটের চাপে পিষ্ট হয়েই এ আন্দোলনে সংযুক্ত হয়েছে এবং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার বিষয়ে বরাবরই শক্ত অবস্থান রেখেছে। কিন্তু দেশে বেকারত্বের হার দেখলে সঙ্গত কারণেই উদ্বেগ বাড়তে শুরু করে।

স্নাতক কিংবা ডিগ্রি সার্টিফিকেটের পরীক্ষা সম্পন্ন করে প্রতি বছর প্রায় ২১ লাখ তরুণ চাকরির বাজারের প্রতিযোগিতায় নামে। সমস্যা হলো, কর্মসংস্থান যে ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দাবি করে তার সঙ্গে এ তরুণদের বিগত বছরের শিক্ষাগত যোগ্যতার মিল থাকে সামান্যই। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। সম্প্রতি এ সংখ্যা যে আরও বেড়েছে তা বলে দিতে হবে না। দেশে বেকারের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। ৫৫টি পাবলিক ও ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ দশমিক ৫ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। তা ছাড়া দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১ হাজার ৯৪১টি টারশিয়ারি মানের ক্লেজ অধিভুক্ত রয়েছে; যেখানে শিক্ষার্থীদের স্নাতক, ডিগ্রি, মাস্টার্স, এমফিলের সুযোগ দেওয়া হয়। এসব কলেজে প্রায় ৪১ দশমিক ৮ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। তারা শিক্ষাজীবন শেষে যখন চাকরির প্রতিযোগিতায় নামবে তখন পরিস্থিতি কেমন হবে সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে দেশে বেকারত্বের হারকেই বিবেচনায় না রেখে সামনে বেকারত্বের সম্মুখীন হতে যাওয়া তরুণদের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা জরুরি।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি পর্যবেক্ষণ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই সামাজিক বিজ্ঞান কিংবা কলা অনুষদের অধীনে অধ্যয়ন করে। ২৪ শতাংশ ব্যবসায় অনুষদের অধীনে এবং মাত্র ১২ শতাংশ বিজ্ঞান, প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান অনুষদের অধীনে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে। আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতায় শিল্প খাত ও নতুন কিছু খাতের আধুনিকায়ন হওয়ায় চাকরির বাজারে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান ও ফলিত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর চাহিদাই বেশি। এ ধরনের দক্ষ শিক্ষার্থীর চাহিদা কারিগরি শিক্ষার্থীর মাধ্যমেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে চাকরির বাজারে এক ধরনের জটিলতা নিয়োগের ক্ষেত্রে বরাবরই লক্ষণীয়। দেশের সেবা খাত বর্তমানে পেশাদার টেকনিশিয়ানদের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের টেকনিশিয়ানরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে কিন্তু তারা উচ্চশিক্ষার সিলেবাসের উন্নততর দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। এজন্য অনেক সময় দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাও অভিজ্ঞতার অভাবে চাকরিক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারে না।

শিল্প খাতে হোয়াইট কলার চাকরির পদে মাত্র ৯ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট নিয়োগ পেয়ে থাকে যা পর্যাপ্ত নয়। সেবা খাতে অবশ্য এ সংখ্যা ২৩ শতাংশ কারণ এখানে কারিগরি পেশাদার বাদেও টারশিয়ারি গ্র্যাজুয়েটরা বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। এ পরিসংখ্যান উল্লেখের মাধ্যমে মূলত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কারিগরি ও উন্নত পরিবর্তনের বিষয়টি চিহ্নিত করার দিকেই আমাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া জরুরি।নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি এস বেকার, পল রোমার ও উইলিয়াম নরধাউসের মতে, কোনো রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনার জন্য প্রতিটি খাতে উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে সবকিছু সম্পন্ন করার জন্য যত ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন তার সবকিছু নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব নিশ্চিত করলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শুধু অভিজ্ঞতাসম্পন্নদেরই সন্ধান করে থাকে। এভাবে অনেক তরুণ চাকরির বাজারে হতাশার সম্মুখীন হয় এবং অনেকে সামাজিকভাবেও নানা হেনস্থার মুখোমুখি হয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি এবং সামাজিক বাস্তবতার চাপে তরুণরা দিশাহারা হয়ে একসময় দেশত্যাগ করে এবং ব্রেনড্রেনের ফলে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ হারাই; যে মানবসম্পদ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারত।

সচরাচর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের মানুষের আয়ের সঙ্গে তুলনা করে এক ধরনের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়। কিন্তু ভিন্ন সমাজবাস্তবতার দিকগুলো বিবেচনা করা হয় না বলে এ ধরনের পরিসংখ্যান বাস্তব কোনো অর্থ দেয় না। উল্টো তা একটি জটিল আকার ধারণ করে। আমরা দেখছি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ১৮ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোয় মানোন্নত শিক্ষা দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযুক্ত কাঠামোই নেই। ফলে সার্টিফিকেট পাওয়া একটা আনুষ্ঠানিকতা এবং একবার সার্টিফিকেট পাওয়ার পর তাদের মনে এমন প্রত্যাশাই থাকে, এবার চাকরির বাজারে সে যোগ্য। এমন মানসিক ভাবনা দ্রুতই ভেঙে যায় এবং চাকরির বাজারে তারা ক্রমেই হারিয়ে যেতে শুরু করে। যারা শিক্ষাজীবনেই নানাভাবে বাজারের দিকে খোঁজ রাখে তারা কোনো না কোনোভাবে চাকরি খুঁজে নিতে পারে। তবে এ সংখ্যা অনেক কম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার বদল তাই জরুরি। যদি তা করা না যায় তাহলে টারশিয়ারি সেক্টরের জন্য দক্ষ কর্মী প্রস্তুত করার মতো শিক্ষা তারা দিতে পারবে না এবং সার্টিফিকেটই একমাত্র সম্বল হয়ে থাকবে সবার জন্য।

২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি জরিপ চালায়। ওই জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন শেষে ফুলটাইম চাকরিতে যোগ দিতে পারে। অন্যদিকে ৪৬ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকে। বর্তমানে শিক্ষার্থী বেড়েছে কারণ পাস করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। ফলে এ হার আরও বেড়েছে যা হয়তো ভবিষ্যৎ জরিপে জানা যাবে। দেশের তরুণ চাকরিপ্রত্যাশী গ্র্যাজুয়েটদের সামনে দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা কিংবা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত. চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া আমাদের দেশেও লেগেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটছে। চাকরিতে কর্মীদের কাছে যে ধরনের দক্ষতা প্রত্যাশা করা হচ্ছে তাতেও বদল আসতে শুরু করেছে। তা ছাড়া শিল্প খাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস এমনকি ব্লকচেইন যুক্ত হওয়ায় এ কারিগরি দক্ষতা অর্জন করাও জরুরি হয়ে পড়ছে; যা টারশিয়ারি শিক্ষার ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীরা পাঠ্যক্রমে পায় না।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমে বদল আনা জরুরি। আমরা এখনও পুরাতন মডেলেই লেখাপড়ায় উৎসাহ দিই। ফলে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলেও শিক্ষার্থীরা অনেক বিষয়ে জটিলতার মুখোমুখি হয়। সামান্য সিভি বানানোর বিষয়টিতেও তারা অস্বস্তিতে ভোগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার নবায়ন জরুরি। বিশেষত ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়াতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তির স্বাদ পেতে পারে। এক কথায় কর্মমুখী শিক্ষা বর্তমান জমানায় অত্যন্ত জরুরি। এমনকি দেশের ব্যবসা খাতের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রগুলো সংযুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের নবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দিতে পারলেও বড় সুবিধা পাবে শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে নিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান, কমিউনিকেশন, ক্রিটিক্যাল ভাবনার মানসিকতা, সৃজনশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, দলগত কাজ করার মানসিকতা এবং ম্যানেজমেন্টে দক্ষতা, পেশাদার নেটওয়ার্কিং, বিষয়ভিত্তিক কারিগরি জ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা, কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষতা, ভাষাদক্ষতা, হিসাবে চৌকশ হওয়া, যেকোনো কার্যক্রম দ্রুত পরিচালনায় দ্বিধায় না ভোগা, ফিন্যান্স-মার্কেটিং-অ্যাকাউন্টিংয়ের মতো বিষয়েও জ্ঞান রাখা এসব বিষয় ভালোভাবে যাচাইবাছাই করা হয়।

কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এসব বিষয়ে সৃজনশীলভাবে নিজ উদ্যোগে দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী নয়। আবার তাদের এসব বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার বিষয়েও দায়িত্বশীল পক্ষের উদ্যোগ নেই। তাই দেশে বেকারত্বের অভিশাপ দূর করতে হলে বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে আগামীতে আমাদের অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়াবে এটি।

লেখকঃ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২১/১২/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.