এইমাত্র পাওয়া

জনসংখ্যা বেড়েছে, ‘মানুষ’ বাড়েনি

আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন।।  

লার্নিং ইজ আ নেভার এন্ডিং প্রসেস। শেখার যেমন কোনো বয়স নেই, তেমনি নেই শেষও। যে কোনো বয়সে, যে কোনো অবস্থাতেই শেখার সুযোগ রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়তই শিখছি—হোক তা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক। আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যে আমাদের শিক্ষিত করে তোলে, সবক্ষেত্রে এমনটাও নয়! একইভাবে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করলেই যে শিক্ষিত হওয়া যায়, এ কথাও ঠিক নয়! মূলত এ কারণেই ‘সুশিক্ষিত’ ও ‘স্বশিক্ষিত’ শব্দ দুটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিচিত হতে হয় আমাদের।

চাকরি সূত্রে নির্ধারিত মৌলিক প্রশিক্ষণ, মাঠপর্যায়ে বাস্তব প্রশিক্ষণ, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের বাইরেও পেশাগত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিচিত্র পরিবেশ-পরিস্থিতিতে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়েও বাস্তব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রতিনিয়তই শিখছি, নিজেকে শানিত করছি।

সরকারি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য পুলিশের সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। সব শ্রেণি-পেশার ছোট-বড় মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। এক কথায়, নিবেদিত প্রাণ হতে হয় রাষ্ট্রাচার কিংবা দেশীয় উত্সব-ঐতিহ্যে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’

যাহোক, একদিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে নিকটস্থ মসজিদে গিয়ে পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই জামাতে নামাজ আদায় করি। আমি একা নই, সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের বেশ কয়েক জন পদস্থ কর্মকর্তা এবং পুলিশের কয়েক জন কনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। নামাজ শেষ হতে না হতেই হঠাত্ চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে এবং শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। বের হতে না পেরে অগত্যা মসজিদেই বসে রইলাম। নামাজ শেষ করে বৃষ্টির কারণে বাইরে যেতে না পেরে আমাদের সঙ্গেই বসে রইলেন বেশ কয়েক জন মুসল্লি। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম এবং সঙ্গে বসা মুসল্লিদের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন, রাতে কোনো চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই হয় কি না, মানুষ রাতে নিরাপদে চলাচল করতে পারে কি না, তাদের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিরাপদ কি না, সন্তান-মা-বোন রাস্তাঘাটে নিরাপদ কি না, স্থানীয়ভাবে কোনো দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ আছে কি না, ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে কি না ইত্যাদি নিয়ে কথোপকথন চলতে থাকে।

আমার বাঁপাশে বসা এক পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের কৃষক। পরনে লুঙ্গি, গায়ে পুরোনো ফুলহাতা জামা। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। লক্ষ করলাম, আমাদের আলোচনা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আলোচনার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে বলে বসলেন, ‘স্যার, জনসংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু মানুষ বাড়েনি তো।’

প্রথমদিকে বুঝতে পারলাম না, কিছুটা অবাকই হলাম। প্রাথমিকভাবে তাকে অস্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিলাম। দ্বিতীয় বার একইভাবে দৃঢ়চিত্তে বললেন, ‘স্যার, জনসংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু মানুষ বাড়েনি।’ ততক্ষণে সংবিত্ ফিরে পেলাম। মনে হলো, শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগল, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল! যেহেতু আমার বাঁপাশে শরীর ঘেঁষেই তিনি বসেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই আমি তার হাতটা ধরলাম। আমার উপলব্ধি হলো, ইনিই তো ‘প্রকৃত মানুষ, প্রকৃত শিক্ষিত’!

‘জনসংখ্যা’ এবং ‘মানুষ’ নিয়ে এমন ভিন্ন ভাবনা আগে কখনোই মাথায় আসেনি। সব শেষ আদমশুমারি-২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন, যেখানে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এই সংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন। সত্যিই তো জনসংখ্যা বেড়েছে! কেবল বাংলাদেশেই নয়, সময়ের ব্যবধানে জনসংখ্যা বেড়েছে বিশ্বব্যাপী। তবে সেই অনুপাতে ‘প্রকৃত মানুষ’ বেড়েছে কি?

মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী জীব, সৃষ্টির সেরা। তবে কেবল জন্মগ্রহণ করলেই কি মানুষ হওয়া যায়? মানুষ হতে লাগে সুন্দর মন-মানসিকতা, মনুষ্যত্ব ও মানবিক গুণাবলি। মনুষ্যত্বই এক্ষেত্রে শেষ কথা। গুণীজনেরাও সেই কথাই বলেন। কবিগুরুর ভাষায়, ‘মনুষ্যত্ব (বিবেকের) শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা, আর সমস্তই তার অধীন।’ মনুষ্যত্ব হলো মানুষের চিরাচরিত বা শাশ্বত স্বভাব বা গুণ। যেমন—দয়া-মায়া, ভালোবাসা, পরোপকারিতা, সহানুভূতিশীল, সম্প্রীতি ও ঐক্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিকার অর্থেই মনুষ্যত্বের শিক্ষা আত্মস্থ করতে পেরেছি? ‘মানুষ’ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? তা যদি না পারি, তাহলে তো ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারিনি! কারণ, মনুষ্যত্বহীন কাউকে কখনোই ‘মানুষ’ বলে গণ্য করা যায় না।

সেই কৃষক ভাই সেদিন মূলত জনসংখ্যার পরিমাণ বা সংখ্যাগত নয়, বরং গুণমান অর্থাত্ মনুষ্যত্ব ও মানবিক গুণাবলির প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তার কথার সঙ্গে একমত না হয়ে পারা যায় না। মানুষ হতে হলে যে মনুষ্যত্ববোধ থাকা প্রয়োজন, মানবিক গুণাবলি অর্জন করা আবশ্যক, বর্তমান সময়ে তাতে যেন বড্ড ঘাটতি রয়েছে। নিঃসন্দেহে পরিসংখ্যানগতভাবে জনসংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে, কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদের উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু বাড়েনি প্রকৃত মানুষের সংখ্যা। মানুষে মানুষে আজ ভ্রাতৃত্ববোধ নেই বললেই চলে। পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, লড়াই, রক্তপাত, মৃত্যুর হলিখেলা, ধ্বংস আর অসম প্রতিযোগিতায় যেন লিপ্ত হয়ে উঠেছি আমরা! পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে আজ একই অবস্থা! ছোটবেলার মান্যতার কালচার এখন কতটা চোখে পড়ে? বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান, আদর, স্নেহ, ভালোবাসায় যেন আকাল চলছে!

সেই কৃষক ভাইয়ের কথা আজো মনের ভেতর গেঁথে আছে। প্রায়ই কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হয় কথাটা। এখনো মনে হলে উপলব্ধি হয়, আসলেই যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কারো কাছ থেকেই শেখার আছে। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই মুখ্য নয়। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পরিবার বা চারপাশের পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরোলেও প্রকৃতির শিক্ষায় কৃষক ভাইটির মতো অনেকে ছাপিয়ে যান জ্ঞান-গরিমায়।

অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে আমাদের জীবনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে, আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সেদিনকার সেই কৃষক ভাইটি। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বটে, কিন্তু মানুষ ও জীবন সম্পর্কে রয়েছে গভীর দর্শন। এ ধরনের ব্যক্তি সবার কাছে ‘প্রকৃত শিক্ষিত’ মানুষ, প্রকৃত ‘মানুষ’।

লেখক :পুলিশ সুপার, নৌপুলিশ, সিলেট অঞ্চল

শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/২০/০৫/২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading