এইমাত্র পাওয়া

সিদ্ধান্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরই নিতে দিন

সৈয়দ আনোয়ার হোসেনঃ বুয়েট তথা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুই ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ চাচ্ছে রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। আরেক ভাগ চাচ্ছে রাজনীতি আসুক। দুই পক্ষেরই যুক্তি আছে। তবে সেখানে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বুয়েটের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে দায়িত্বশীল হিসেবে উপাচার্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৭২ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। উপাচার্য ছিলেন মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী। তাঁর কাছে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষার্থীরা গিয়ে অটোপ্রমোশনের দাবি জানায়। তারা বটতলায় মিছিল-মিটিং করে; উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপিও দেয়। তিনি রেগেমেগে বললেন, আপনাদের অটোপ্রমোশন কেবল আমার মৃতদেহের ওপর দিয়েই হতে পারে। আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের কক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়; ফোন সংযোগ কেটে দেয়; পানিও বন্ধ করে দেয়। তিনি অসুস্থ মানুষ; ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ছিল।

ওই দিন সাড়ে ৩টার সময় বঙ্গবন্ধু খোঁজ পেলেন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অবরুদ্ধ। তিনি নিজেই চলে এলেন। আন্দোলনকারীদের ধমক দিয়ে তালা খোলালেন। আমার নিজের চোখে দেখা– বঙ্গবন্ধু উপাচার্যকে বলেছেন, স্যার, পোলাপাইনরে মাফ কইরা দেন। তিনি চাইলেন উপাচার্যকে নিজের গাড়িতে করে বাসভবনে পৌঁছে দিতে। মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী বললেন, আমি হেঁটেই যেতে পারব। এর পর কাঁপতে কাঁপতে উঠে হাঁটতে শুরু করলেন। পরে দু’জন দুই পাশ থেকে গিয়ে দাঁড়ালে তাদের কাধে ভর দিয়ে বাসভবনে চলে গেলেন। সেই উপাচার্য আমি দেখেছি; আর এখন আমরা কী দেখছি?

মধ্য ষাটের দশকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ওই সময় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা ছিল। প্রথম বছর এসএম হলের পশ্চিম বাড়ির দোতলায় ১৩৮ নম্বর রুমে আমার অবস্থান ছিল। আমার পাশের বিছানায় ছিলেন আব্দুল আজীজ বাগমার, অপূর্ব সংসদের প্রতিষ্ঠাতা। আমিও সেই সংসদের সদস্য ছিলাম। তাঁর পড়াশোনা দেখেছি, আচরণ দেখেছি। আব্দুর রাজ্জাক ভাই বড় নেতা। তাঁর পড়াশোনা দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার পড়াশোনা দেখেছি।

আমার কথা হচ্ছে, ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত থাকবে কিনা– সেই সিদ্ধান্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি থাকতে হবে। তবে সে রাজনীতি জীবনঘনিষ্ঠ। যে রাজনীতি জীবনের কল্যাণধর্মী দিকটি নিশ্চিত করবে, সেই রাজনীতি থাকতে হবে। আজকের ছাত্র রাজনীতির মধ্যে আমি ছাত্রও পাচ্ছি না, রাজনীতিও পাচ্ছি না। ছাত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বই-খাতা-কলম থাকবে, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকবে, গ্রন্থাগারে থাকবে। কিন্তু সেখানে এদের পাওয়া যাচ্ছে না। এরা মোটরসাইকেল বা গাড়িতে যাতায়াত করে। টেন্ডারবাজি করে। বাংলা একাডেমিতে থাকার সময় সে অভিজ্ঞতা আমার খুব ভালো হয়েছে।

একটা কথা মনে রাখতে হবে– ছাত্রলীগ কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে দেড় বছরের বড়। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে চিরকুট পাঠাতেন, ডেকে আলোচনা করতেন। আমি এর সাক্ষী। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ থেকে ছাত্রলীগের কমিটি করে দেওয়া হয়। কেন তা করা হবে? ছাত্রলীগের নিজস্ব অস্তিত্ব কোথায়?
মৌলবাদের কথা বলা হচ্ছে। মৌলবাদী রাজনীতি হলে তো ভালো। মৌলবাদী ইসলাম অথচ ইসলামের মূলের অনুসরণ নেই। ধর্মান্ধতার রাজনীতি বলা যায়। সব জায়গায় যেমন ছাত্রলীগ আছে; ধর্মান্ধতার রাজনীতিও আছে। কোথায় নেই? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তো আছে।

আবরার ফাহাদকে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগ। তার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষক মিলে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটা আদালত বাতিল করে দেন। আমি মনে করি, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষের দুটি কাজ হঠকারী হয়েছে। একটা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চটজলদি শিক্ষার্থীর সিট বাতিল করে দিয়েছে। ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ছয় সদস্যের কেন? বেজোড় সংখ্যা হবে। হয় ৩ হবে বা ৫ অথবা ৭। তার মানে, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে।

আদালতের নির্দেশে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল হলো। কথা হলো, আদালতই যদি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারেন, তবে সেখানে ছাত্র, উপাচার্য বা প্রশাসনিক ব্যক্তির প্রয়োজন আছে কি? আমি মনে করি, এখানে সিদ্ধান্তটা নিতে হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরই।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছিল, সেটাও সংগত নয়। প্রধানমন্ত্রী কি সব কাজই করবেন? তাহলে উপাচার্য কেন নিয়োগ দিয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন আছে?

অধ্যাপক আইনুন নিশাত যথার্থই বলেছেন। ১৯৭৩ সালে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যখন স্বায়ত্তশাসন দিয়ে অধ্যাদেশ জারি হলো, তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আইন মন্ত্রণালয়ে যান তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও একই রকমের অধ্যাদেশ করে দিতে। কিন্তু সেটি হয়নি।

হেনরি নিউম্যান একটা বই লিখেছেন, ‘দি আইডিয়া অব আ ইউনিভার্সিটি’। বিশ্ববিদ্যালয় বলতেই স্বায়ত্তশাসন। এখানে বাইরের হস্তক্ষেপ চলে না। অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেছেন, বুয়েটের একটা বিশেষ চরিত্র আছে। বিশ্বব্যাপী নন্দিত এবং স্বীকৃত। সেই চরিত্রকে অবিকল রেখে, যা কিছু করার তা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

তথাকথিত রাজনীতির নামে; তথাকথিত বলছি এ জন্য, বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি দেখছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিষিয়ে ফেলা উচিত নয়। এমন রাজনীতির প্রয়োজন নেই, যাতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়াবিমুখ হয়ে যায়। রাজনীতি জীবনঘনিষ্ঠ ব্যাপার। একে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি সচেতন থাকবে। কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি করতেই হবে কেন?

বুয়েটের রাজনীতি বিষয়ে বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই সিদ্ধান্ত নিক। সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সেটা করা উচিত। সেখানে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না– একটা রেফারেন্ডাম তথা গণভোটও হতে পারে।

লেখক: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৪/০৪/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading