শিক্ষার মানোন্নয়ন কি সম্ভব?

।। ড. কামরুল হাসান মামুন।।

সত্যিকারের আদর্শিক মানুষদের শূন্যতা এখন প্রবল। এখন যারা মডেল তারা কি আসলেই আদর্শিক মানুষ? নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন কাদের মডেল ভাবছে? এইভাবে প্রিয় দেশটা আজ দুঃসহ সময় পার করছে। এই পথকে আরও পিচ্ছিল করার জন্য সরকার নতুন একটা শিক্ষাক্রম তৈরি করেছে যার মাধ্যমে উদাহরণ হওয়ার মতো বড় মানুষ তৈরির পথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ষাট বা আশির দশকেও অনেক বড় আলোকিত মানুষ ছিল। বড় কবি ছিলেন, বড় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, নাট্যকার, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক ছিলেন। যেমন ৬০ ও ৭০ দশকের বাংলাদেশের কবি লেখক কারা ছিলেন—শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আহমদ শরীফ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হেলাল হাফিজ, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আহমদ ছফা, আলমগীর কবির, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আলতাফ মাহমুদ, ফজলে লোহানী এইরকম আরও অনেক নাম নেওয়া যাবে।

সবার নাম এই মুহূর্তে মনেও আসছে না। ফজলে লোহানী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, নিলুফার ইয়াসমিন, আজম খানের মতো গায়ক, জুয়েল আইচের মতো জাদুশিল্পী, আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো গীতিকার কি আমরা তৈরি করতে পারছি?

শুধু জাতীয় পর্যায় না। আমাদের গ্রাম পর্যায়েও উদাহরণ দেওয়ার মতো শিক্ষক ছিলেন, রাজনীতিবিদ ছিলেন, ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন চোখ খুললেই স্মার্ট ধান্দাবাজ দেখি, স্মার্ট দুর্নীতিবাজ দেখি, স্মার্ট ঋণখেলাপি, স্মার্ট আমলা দেখি।

ভালো মানুষ কীভাবে তৈরি করতে পারবো? যারা কবি, সাহিত্যিক, লেখক, অভিনেতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক হতে পারতো তাদের বিরাট অংশ পড়ে ইংরেজি মাধ্যমে। যারা বাংলাভাষা ঠিক মতো পড়েনি, বাংলা সাহিত্য পড়েনি, বাংলা গান শোনেনি তারা লেখক হবে কীভাবে?

এই যে এত শত শত ছেলেমেয়েরা বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তাদের সরকারি চাকরিতে কীভাবে নেওয়া যায় সেই চিন্তা কি কেউ করেছে?
আপন ভাষায় না পড়লে জানা, শেখা ও বোঝা হয় ভাসা ভাসা। এরা ভালো হতে পারতো ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট অংশ বড় হয় বিদেশে চলে যাবে স্বপ্ন নিয়ে। তাদের স্বপ্নগুলো খুব ছোট। বিদেশে গিয়ে একটু পড়াশোনা করে একটা ছোটখাটো চাকরি পেলেই নিজে এবং তাদের বাবা-মায়েরা সফল মনে করে।

অথচ আমরা যদি বাংলা মাধ্যমকে উন্নত করতে পারতাম এবং ওরা যদি বাংলা মাধ্যমে পড়তো তাদের একটা বড় অংশই লেখক, শিক্ষক, গবেষক হতো। এই ইংরেজি মাধ্যম দিয়ে আমরা কী পাচ্ছি তার কি কোনো গবেষণা আছে? কেউ কি ভাবছে?

৪০ বছরের ইংরেজি মাধ্যম দিয়ে দেশ কী পেল আর কী হারালো? যারা গেল তারা ফিরে আসলেও তাদের কি যথোপযুক্ত চাকরির জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থা? এই যে এত শত শত ছেলেমেয়েরা বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তাদের সরকারি চাকরিতে কীভাবে নেওয়া যায় সেই চিন্তা কি কেউ করেছে?

বাংলা মাধ্যমের স্কুল ও কারিকুলামকে নষ্ট করে আমাদের নষ্ট হওয়ার পথ আরও পিচ্ছিল করে দ্রুত সেই পথে নামার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখন আর কেউ বড় হয় না। যারা বিসিএস পরীক্ষায় বসে তাদের স্বপ্ন থাকে প্রশাসন, রাজস্ব, পররাষ্ট্র বা পুলিশ ক্যাডার হওয়ার। কিংবা শিক্ষা ক্যাডার ছাড়া অন্য যেকোনো ক্যাডার। কেউ শিক্ষা ক্যাডার পেলে তত খুশি হয় না। মন্দের ভালো ভেবে হয়। হলে তাদের কেউ অভিনন্দনের বন্যায় ভাসায় না।

এমনকি শিক্ষা ক্যাডার পাওয়া ব্যক্তিও পরের বছর আবার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আশায় থাকে অন্য কোনো ক্যাডারে যাওয়ার। এর কারণ হলো, অন্যান্য ক্যাডারে ক্ষমতা আছে। শিক্ষকের কোনো ক্ষমতা নেই। সরকার নিজের স্বার্থে শিক্ষকতা ও অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক সম্মানের দিক থেকে অনেক বেশি বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে।

ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ মানুষের থাকবেই। কিন্তু মানুষ এখন দায়িত্বকে ক্ষমতা হিসেবে ধরে নিয়েছে। কাউকে বঞ্চিত করে বা অত্যাচার করে তার ওপরে আধিপত্য প্রকাশ করাকে তারা ক্ষমতা মনে করে।
শিক্ষক জ্ঞানের ধারা সচল রেখে সমাজকে অজ্ঞানতার আবর্জনা থেকে মুক্ত রাখে। মুখে সবাই বলে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু জাতীয় বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ দেখুন! পৃথিবীর যেসব দেশ শিক্ষায় সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর তলানিতে। যতটুকু দেয় তাতেও আছে ছলচাতুরী।

প্রযুক্তির বরাদ্দকেও শিক্ষার সাথে যুক্ত করে দেয়। শিক্ষায় এত কম বরাদ্দ দিলে সঙ্গত কারণেই শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা কম দিতে হবে এবং করাও হয় তাই। তার উপর দেখা যায় একজন প্রশাসন ক্যাডার শিক্ষকের ওপর ছড়ি ঘোরায়। দুইদিন পরপর কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তা নিয়ে প্রজ্ঞাপন পাঠায়।

শিক্ষকতা পেশা এমন হওয়া হওয়া উচিত যেখানে শিক্ষকরা মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে। শিক্ষকদের মুক্ত স্বাধীন জীবন ও নিরাপত্তা না দিতে পারলে শিক্ষকরা সৃষ্টিশীল হবে কীভাবে? প্রশাসন ক্যাডারের প্রশাসকরা ঠিক করে দেয় শিক্ষকের কোথায় বদলি হবে, তার প্রোমোশন হবে কিনা। শিক্ষকরা তো সরকারের কাছে গাড়ি, বাড়ি চায় না। আমলাদের যেখানে গাড়ি উপহার দেওয়া হয়, শিক্ষকদের সেই জায়গায় ভালো বেতন দিতে শত কার্পণ্য।

ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ মানুষের থাকবেই। কিন্তু মানুষ এখন দায়িত্বকে ক্ষমতা হিসেবে ধরে নিয়েছে। কাউকে বঞ্চিত করে বা অত্যাচার করে তার ওপরে আধিপত্য প্রকাশ করাকে তারা ক্ষমতা মনে করে। আসল ক্ষমতা তো পদাধিকার বলে কোনো সেক্টর থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে আনার মধ্যে।

আমাদের দেশের মানুষের ক্ষমতার প্রতি লিপ্সা অনেক বেশি। এর একটা বড় কারণ হলো, একটি গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের যে ক্ষমতা থাকার কথা, তা এখানে নেই। নেই কোনো নাগরিক অধিকার ও সুবিধা। প্রতিদিন এদেশের নাগরিকরা এত বেশি বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে যে, যতটুকু ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছে, তা-ই আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। নাগরিক হিসেবে কোনো ক্ষমতা নেই বলেই, ক্ষমতার ক্ষুধা আমাদের এত বেশি।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

শিক্ষকের ঋণ অপরিশোধ্য

বিপ্লব বড়ুয়াঃ মানুষ মাত্রই কোনো না কোনো গুণের অধিকারী। গুণের রয়েছে নানা শ্রেণিবিন্যাস। গুণবান মানুষ …