ড. কামরুল হাসান মামুনঃ আমার বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। আজ পর্যন্ত একজন রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, ব্যবসায়ীকে দেখলাম না যিনি তার আপন সন্তানকে ছাত্র রাজনীতি করতে বলেছেন, মিছিলে ও রাজনৈতিক মিটিংয়ে যেতে বলেছেন। ছাত্র রাজনীতি বলতে শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি (যেটা আসলে জাতীয় রাজনীতি) না, আদর্শভিত্তিক বাম ছাত্র রাজনীতিও। অর্থাৎ বাবা ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি, অথবা বাম ছাত্র সংগঠন করা হলেও নিজের সন্তানকে এসব থেকে যোজন যোজন দূরে রেখেছেন। দেখেছি নিজ সন্তানকে কীভাবে পাহারা দেওয়ার মতো করে আগলে রাখতে। আর্থিক সামর্থ্য থাকলে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গার্ড দিয়ে রেখেছেন যেন ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে না পরে। উপদেশ দিয়েছেন লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না বলে ভালো করে লেখাপড়া শেষে বিদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যেতেও বলেছেন। যদিও আবার দেশে ফিরে এসেছে। এসেই বাবার কোম্পানিতে বস হয়ে গেছে। অথবা সরাসরি বা ডাইরেক্ট নেতা বানিয়েছেন।
অথবা যদি ভালো চাকরি পেয়ে যায় তাহলেও রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। এই দেশের রাজনীতি মানে কি তারা খুব ভালোভাবে জানে বলেই নিজের সন্তানকে এই দিকে আনেননি। আর আসলেও বাপের রাজনীতির সুবাদে সরাসরি এমপি নির্বাচন করে ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি, রাজউকের প্লট ইত্যাদি ভাগিয়ে নেওয়ার পথ দেখিয়েছেন। আজ পর্যন্ত নিজে ডান, বাম, মধ্যম রাজনীতি করে সন্তানকে একই পথে হাঁটিয়েছেন এমন বাবাকে আমি পাইনি। বরং দেখেছি নিজের সন্তানকে কখনো সেই একই পথ মারাতে বলেন না শুধু না বারণ করেন। কিন্তু অন্যের সন্তানদের রাজনীতি করতে উদ্বুদ্ধ করতে ছাড়েন না। তখন ছাত্র রাজনীতি খুব ভালো। তখন বলবে তোমরা রাজনীতি না করলে দেশের হাল ধরবে কে? ছাত্র রাজনীতি না করে নেতৃত্ব শেখা যায় না। যেন উন্নত বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ তৈরি হচ্ছে না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চালু থাকুক, তাদের তোষামোদি করুক, তাদের কথামতো চলুক তারা সেটা চায়। এতে ছাত্রদের লেখাপড়া ক্ষতি হয় কিনা, ছাত্রদের স্বপ্নের অপমৃত্যু হয় কিনা সেই দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। আসলে আমাদের দেশে যেটাকে আমরা ছাত্র রাজনীতি বলছি সেটা ছাত্র রাজনীতিই না। ছাত্ররা আসলে করে জাতীয় রাজনীতি এবং নিজেদের হীন স্বার্থে সেই রাজনীতি চালু রাখতে চায় কারণ এতে তাদের লাভ। সেই লাভ চান কিন্তু নিজের সন্তান এই একই কাজ করুক সেটা চায় না। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন যারা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির জন্য মায়াকান্না করছে আর বলছে ছাত্র রাজনীতি না থাকলে দেশ উচ্ছন্নে যাবে তারা তাদের নিজের সন্তনরা সেই রাজনীতি করছে কিনা। এরা বলবে অন্যায়ের প্রতিবাদতো ছাত্ররাই করবে।
কেন বাবা। তোমরা কোন লবা ছেড়ার জন্য রাজনীতি কর? অন্যের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে নিজের সন্তানদের জন্য কানাডা আমেরিকায় বাড়ি করার জন্য? লাহার ফুতাইনদের ন্যূনতম সততা বোধ যদি থাকতো এইসব করতো না। যাহা নিজের সন্তানকে দিয়ে করানো যায় না তাহা অন্যের সন্তানদের দিয়ে কীভাবে করায় বা করাতে চান? এদের কি মুখে সরম, চোখে লাজ একটুও নাই? সততা থাকলে, সৎসাহস থাকলে বলুন আপনার নিজের সন্তান কি করছে, কোথায় পড়েছে? নিজের সন্তান আবাসিক হলে থেকে নির্যাতিত হলে, জোর করে মিছিল মিটিংয়ে নিলে বুঝতো। বুঝিবে কীভাবে কী যাতনা বিষে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.