মানুষ নুতন কোন সত্য ও কল্যাণময়ী তত্ত্বকে সহজে মেনে নেয় না, আমি বলব এটা মানুষের একটা প্রবৃত্তি। তারা মনে করে, যে দীক্ষায় আমরা দীক্ষিত এটাই শেষ, এটাই চুড়ান্ত, এটাই আসল, হোক সেটা সর্ব জন বিদিত বা কুসংস্কার। সবার ধারণা যে পথে বা যে দীক্ষায় আছি আবার নুতন কি? পরমেশ্বর ও তার অমিয় বানী ছাড়া সব কিছু পরিবর্তন যোগ্য।
এক সময় মানুষ ছিল যোগাযোগহীন। এর পর পাখির পায়ে পত্র লিখে তা পাঠিয়ে দিত যোগাযোগ বা খবরাদি বিনিময় করার জন্য আজ ই-মেইল, হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদির মাধ্যমে খবরাদি চলে যায় পৃথীবির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বারাক ওবামা যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হল তার নির্বাচনী প্রচারণার মূল বিষয় ছিল Change বা পরিবর্তন। কারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব Superlative degree
আজ আমার লিখনীয় মূল বিষয় হল জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১। বাংলাদেশ শিক্ষাকে যুগোপযোগী আধুনিক ও বিশ্ব মানের উপযোগী করার জন্য অনেক বার শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, অনেক শিক্ষা ক্রমের প্রবর্তন হয়েছে। আমি সেসব শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষা ক্রমের সফলতা বা বিফলতা নিয়ে আলোকপাত করব না ।
রাষ্ট্র চায় একটা উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সুন্দর শিক্ষিত জাতি তৈরী হয় এর আলোকে । বিরামহীন গবেষনার মাধ্যমে প্রবর্তন করেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১। এই শিক্ষাক্রম হঠাৎ করে আসেনি বা চাপিয়ে দেয়া হয়নি। রাষ্ট্র যখন চিন্তা করল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হতে হবে চ্যালেজিং যুগোপযোগী প্রযুক্তি নির্ভর যেন প্রতিটি নাগরিক হয় একটা জন শক্তি । সকল নাগরিক যেন হয় রাষ্ট্রের মানব সম্পদ। এই মানব সম্পদ যেন সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কে একটি উন্নত দেশ হিসাবে বিশ্ব মান চিত্রে স্থান করে দিতে পারে। আজ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিতে চায়।
বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ
১। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা।
২। এক বিশ্ব শতাব্দীর তথ্য ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
৩। জ্ঞান, দক্ষতা, ইতিবাচক দৃষ্টি ভংগি আলোকে দূরদর্শী, সংবেদনশীল অভিযোজন সক্ষম, মানবিক ও যোগ্যতা সম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরী করা।
৪ । চতুর্থ শিল্প বিল্পবের চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে সফল হওয়া।
৫। যোগ্যতা সম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরী পূর্বক সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের শীর্ষে নেয়া
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সনাতনী মুখস্থ ও পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সম্ভব নয় প্রয়োজন যুগোপযোগী যোগ্যতা সম্পন্ন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
এ জন্য রাষ্ট্রের তাগিদে শিক্ষা বিদরা অনেক তথ্য, তত্ত্ব, অনেক শিক্ষা বিদদের মতামত গ্রহন করে কার্যকর যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষা ক্রমের কাজ শুরু করেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড এনসিটিবি সর্বশেষ ২০১২ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন বরেন কিন্তু যা ছিল বিশ্ব চ্যালেঞ্জিং এর অপ্রতুল। তাই দার্শনিক, মনোবৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক প্রমাণ নির্ভর ভিত্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট প্রয়োজন ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ টিকে থাকার জন্য ২০১৭ হতে ২০১৯ ব্যাপক গবেষণা ও কারিগরি অনুশীলন পরিচালিত হয় যার প্রেক্ষিতে নুতন এই শিক্ষা ক্রম প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে সার্বজনীন বিজ্ঞান ভিত্তিক যে একীভূত শিক্ষার কথা সুপারিশ করা হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট ও নির্দেশনানুসারে এই শিক্ষা ব্যবস্থা যার মূল লক্ষ্য টেক সই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDG) ৪ অর্জন, যার মূল লক্ষ্য সকলের জন্য একীভুত ও সমতা ভিত্তিক গুনগত যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করণ এবং জীবন ব্যাপি শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা আমাদের সমাজে একটা ধারণা আছে শিক্ষা জীবন মানে ছেলে মেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে আর সেখানে পড়াশুনা করবে আর বাড়ীতে পড়ার টেবিলে পড়া প্রস্তত করে আবার বিদ্যালয়ে যাবে। এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে একটা জাতি উন্নতি হতে পারে না বরং ঐ শিক্ষার্থী সংসার বা পিতা মাতার কাছে একটা বোঝা হয়ে দাড়ায়। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীকে যদি শিক্ষা অর্জন কালীন যোগ্যতা সম্পন্ন একজন শিক্ষার্থী হিসাবে গড়ে তোলা যায় তাহলে সে লব্দ যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষা জীবনেই বোঝা নয় একজন আয় উপযোগী মানব সম্পদ হিসাবে পরিণত হয়। একটা বিষয় পরিস্কার হবার দরকার যোগ্যতা মানে কি? যোগ্যতা হল দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধ দক্ষতা ও জ্ঞান এই চার উপাদানের সমষ্টি। আমরা বিভিন্ন শ্রেণিতে বিবিধ বিষয় ভিত্তিক অধ্যায়ে পাঠদান করি এই পাঠদান শুধু শ্রেণিতে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি হাতে কলমে বা ব্যবহারিক শিখনের মাধ্যমে যদি শিক্ষার্থীকে গড়ে তুলতে পারি তাহলে ছাত্র জীবন হতে সে হয়ে উঠবে একজন দক্ষ কর্মবীর। যেমন কোন অধ্যয় যদি থাকে ধানের চাষাবাদ বিষয়ের, আমরা যদি প্রথমে তাকে কিভাবে ধান হতে অংকুরোদম করতে হবে, কিভাবে বীজ তলায় চাষাবাদ করতে হবে কখন কিভাবে সার প্রয়োগ করতে হবে, কিভাবে বীজ তলা হতে বীজ তুলতে হবে। আবার তা কিভাবে জমিতে রোপন করতে হবে। রোপনের আগে পরে কি পরিচর্য্যা করতে হবে। সর্বশেষ কিভাবে ফসল ঘরে তুলতে হবে এবং তা সংরক্ষণ করতে হবে। এই চাষাবাদ প্রক্রিয়াটি যদি আমরা হাতে কলমে শিক্ষা দিতে পারি তাহলে শিক্ষা অর্জন তো হলোই সাথে সাথে একজন দক্ষ চাষী হবে। এমনি ভাবে সকল বিষয় যদি আমরা শিক্ষা জীবনে শ্রেণিতে না পড়িয়ে হাতে কলমে উপযুক্ত স্থানে যদি ব্যবহারিক জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে পারি তাহলে একজন শিক্ষার্থী আর বোঝা নয সে একই সাথে একজন শিক্ষার্থী ও একজন দক্ষ মানব সম্পদ হবে। এভাবে প্রতিজন শিক্ষার্থী কে যদি ব্যবহারিক জ্ঞান লব্দ ভাবে তৈরী করা যায় তাহলে প্রতিটা নাগরিকই হবে দক্ষ মানব সম্পদ।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষই হল সকল শিক্ষার্থী যোগ্যতা সম্পন্ন একজন শিক্ষার্থীকে তৈরী করা । বহির্বিশ্বে অনেক দেশে এই ভাবে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলেছে। তারা নিজেরা মোবাইল, ফ্যান, লাইট, কম্পিউটার সহ বিবিধ পণ্য নিজেরা তৈরী করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অন্য দেশে বাজারজাত করছে।
আসলে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে দেশের সকল পর্যায়ের জনগণ কে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। আমাদের দেশের এখনও জন সংখ্যার অর্ধেক জন সম্পদ নয় এখনও শিক্ষার্থী ও নারী সমাজের অধিকাংশরাই কর্মহীন। তারা পরনির্ভরশীল। সংসারের কর্তা ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল যা অনেক ক্ষেত্রে সংসার সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা ৷
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য হল ও অভিজ্ঞতা লদ্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থী যাতে একজন যোগ্যতা সম্পন্ন দক্ষ, কর্মমুখী শিক্ষার্থী তথা নাগরিক হিসাবে তৈরী হয়।
বাস্তবায়ন
শুরুতেই বলছি নুতন কোন কিছুই মানুষ সহজে মেনে নিতে চায় না। পক্ষের চেয়ে বিপক্ষের অবস্থানের সংখ্যা বেশী থাকে। এই শুধু শিক্ষালয় শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের দিয়া সম্ভব নয় কারণ বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমাজের সর্ব শ্রেণীর অভিভাবকদের সন্তানরা এখানে শিক্ষা শিক্ষালাভ করে। তাই আমি মনে করি প্রথমেই সর্বস্তরের মানুষের সাথে এর সুফল প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তবে এই অবহিত করণ কর্ম যজ্ঞটি শুধু মাত্র বিদ্যালয়ের উপর চাপিয়ে না দিয়ে প্রশাসন স্থানীয় সরকার এর মাধ্যমেও সচেতনতা তৈরী করা যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রশাসনের ও জন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অবহিত করণ সভা আয়োজন করে সকল কে এর সুফল অবহিত করা যায়।। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষনের পাশাপাশি বিদ্যালয় ইন-হাউজ প্রশিক্ষন আয়োজন পূর্বক শিক্ষকদের যোগ্য হিসাবে তৈরী করা উচিত সেই সাথে একজন শিক্ষক কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করল তার দক্ষতা কোন পর্যায়ে তার একটা মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা উচিত। মনে রাখতে হবে As The teacher, So the Students,
ধমক নয় চমক দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে অর্থ্যৎ উৎসব মুখর পরিবেশে আনন্দের মাঝে শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে হবে ।
সেশন কালীন সময়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদর্শন এবং যথাযথ ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে যাতে দক্ষতা অর্জন করতে পারে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যে নির্দেশা দেয়া হয় তা যথাযথ ব্যস্তবায়ন করতে হবে।
পরিদর্শন কার্য্যক্রম বেগবান করতে হবে। শিক্ষাক্রমের আসল উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়ন হল তা তথ্য সংগ্রহ পূর্বক প্রতিষ্ঠান, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয়, পর্য্যায়ে র্যাংকিং আকারে শিক্ষা মন্ত্রনালয় প্রকাশ করবে। এতে সকল পর্যায়ে বাস্তবায়নের একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হবে এবং সরকারের ও শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য পূর্ণতা পাবে ।
দীর্ঘ বছর ধরে আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি চলমান ছাত্র, শিক্ষক অভিভাবক পরীক্ষা শেষে ফলাফল প্রাপ্তিতে অধীর আগ্রহ থাকে । পূর্বে ছিল Stand,Star,First division,Second division, Third division
পরবর্তীতে A+, A, A-, B, C, D
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মাঝে A+ (গোল্ডেন A+) প্রাপ্তির একটা প্রতিযোগিতা এতই প্রবল যে অনেক সময় শিক্ষার্থী অধিক চাপে পিষ্ট হবার উপক্রম হয় শুধু তাই নয় অনেক অভিভাবকরা একে অপরকে তার সন্তানের রেজাল্ট নিয়া অহংকারাত্নক গর্ববোধ ও আলাপ আলোচনা করত। বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রমে এই অশুভ প্রতিযোগিতা হিংসাত্বক মানোভাব বিলুপ্তির একটা পরোক্ষ কৌশল বিদ্যামান। অনেক অভিভাবক এখনও প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার ফলাফলে বিশ্বাসী তাই তাদের এ বিষয়ে অবহিত করণ সভা করে সম্যক ধারণা দিতে হবে যাতে তারা জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এর সুফল সম্পর্কে অবহিত হতে পারে ।
সর্বপরি সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ সফল হোক প্রতিটি শিক্ষার্থী যাতে বাংলাদেশ কে একটি উন্নত দেশে পরিণত করা, চতুর্থ শিল্প বিল্পব ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দক্ষ মুক্তি যুদ্ধের চেতনার সু-নাগরিক হিসাবে আত্ন প্রকাশ করতে পারে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা ।
লেখকঃপ্রধান শিক্ষক, শহীদ শেখ রাসেল মুজিব মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মোরেলগঞ্জ,বাগেরহাট।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৪/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.