নিউজ ডেস্ক।।
গত কিছুদিন ধরে পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদরাসায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ নিয়ে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হচ্ছে। এতে তথাকাথিত প্রগতিশীলরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এটাকে ‘ভালো আলামত’ বলে তারা মনে করছেন না। কেন মনে করছেন না, তার সঠিক ও যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা তারা দিতে পারছেন না। অন্যদিকে, মাদরাসায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধি বর্তমান শিক্ষানীতির প্রতি গণঅনাস্থার ফল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
শুধু মাদরাসায়ই নয়, শিক্ষার্থীর সংখ্যা টেকনিক্যাল, ভোকেশনাল, ইংলিশ মিডিয়ামেও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে গতকাল ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যুরো অফ এডুকেশনাল ইনফরমেশন ( বেনবেইস) আয়োজিত বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ শীর্ষক ওয়ার্কশপে উত্থাপিত পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলা হয়, মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। গত চার বছরে ১০ লাখের বেশি মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
অন্যদিকে, ২০০৯ সাল থেকে মাদরাসা, টেকনিক্যাল ও ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষাবিদরা এর কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, পড়াশোনার খরচ বৃদ্ধি, নি¤œমানের শিক্ষা ও মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করেছেন। তবে তাদের কেউ কেউ মদরাসায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের এই উদ্বেগ কেন ও তারা কোন চেতনা থেকে আসা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
মাদরাসায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধি নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত খুশি। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে মাদরাসায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া, মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য ধর্মের সংস্কৃতিকে গৌরবান্বিত করে তোলা হয়েছে, তা তারা মানতে পারছে না, পারারও কথা নয়।
শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দেশের ইসলামী দল এবং সাধারণ মানুষ ব্যাপক প্রতিবাদ করেছে ও করছে। তাদের প্রতিবাদের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করার কথা বলেছে। তবে শিক্ষাবর্ষের তিন মাস চলে গেলেও তা এখনও পরিবর্তন করা হয়নি। চরমোনাইয়ের পীরসাহেব এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামবিরোধী শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকে, এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে নাস্তিক্যবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এতে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ শেখার কিছু নেই। আজকে যে কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠেছে, সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার নামে ধর্মকে উচ্ছেদ করার পরিনাম বলেই মনে করেন অনেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের অভিভাবকরা অত্যন্ত সচেতন। তারা সন্তানকে কোথায় পড়াতে হবে এবং সন্তান কোথায় পড়বে, তার সিদ্ধান্ত তারাই নিয়ে থাকেন। শুধু শিক্ষার জন্য নয়, তারা শিক্ষার মাধ্যমে সন্তানদের নীতি-নৈতিকতা, আদব-কায়দা, মূল্যবোধ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সন্তানরা এসব মানবিক গুণাবলী থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে অভিভাবকরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি তারা এ শিক্ষায় সন্তানকে দিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, মাদরাসা শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থী অত্যন্ত সুশৃঙ্খল জীবনধারার মধ্য দিয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠে। বর্তমানে বহু মাদরাসা আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাসমৃদ্ধ শিক্ষা প্রদান করছে। এতে একজন শিক্ষার্থী যেমন দীনি শিক্ষা পাচ্ছে, তেমনি আধুনিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত হয়ে উঠছে।
মাদরাসার অনেক শিক্ষার্থী স্কলারশিপ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। মদিনা ও মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সুযোগ পাচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এখন মাদরাসা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সন্তানদের সেখানে পড়াচ্ছেন। এবতেদায়ী মাদরাসাগুলো মাদরাসা শিক্ষার ভিত রচনার কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করছে।
তবে এ মাদরাসগুলো বরাবরই বৈষম্যের শিকার হয়েও শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে ছাড় দিচ্ছে না। মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সেক্যুলার-নাস্তিক্যবাদী শিক্ষাবিদরা উদ্বেগ প্রকাশের কারণ সম্পর্কে সকলেই অবগত। মাদরাসা শিক্ষা বিষয়ে তারা ‘জঙ্গী’ জুজুর ভয় দেখায়।
এ নিয়ে তারা ব্যাপক অপপ্রচার করে মদারাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা করেছে। অথচ গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্পষ্ট করে বলেছেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আমরা যত জঙ্গি ধরেছি, তার মধ্যে একজনও মাদরাসার ছাত্র ছিল না।’ তার এ কথার পর মাদরাসাবিরোধীদের আর কথা থাকতে পারে বলে মনে হয় না।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। নাদান হলে এমনই হয় বলে মনে করেন অনেকে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকতার নামে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে বিতর্কিত বিষয় যুক্ত কারা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। সময়ের সাথে পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক, তবে এমন পরিবর্তন নয়, যা শিক্ষার্থীদের ভুল শিক্ষা দেয় এবং বিতর্ক সৃষ্টি করে।
পর্যবেক্ষকরা নবিশ নয়, একজন বিদগ্ধ ও দক্ষ শিক্ষামন্ত্রীই প্রত্যাশা করেন। তাছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এমন ব্যক্তিদের যুক্ত করা উচিৎ, যারা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের রীতি-নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে ভিত্তি করে উপযুক্ত এবং যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যার প্রতি অভিভাবকদের আস্থা নেই।
তারা সন্তানদের এমন শিক্ষা দিতে চান না, যে শিক্ষা নৈতিকতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তে গ্যাং কালচার গড়ে তুলতে সহায়তা করে। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে তা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে হবে।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপদেষ্টা কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীর মতো প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞদের এ ব্যাপারে দৃঢ় ভূমিকা রাখা উচিৎ।
তারা দেশের মানুষের চিরায়ত নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সেন্টিমেন্ট সম্পর্কে যেমন অবগত, তেমনি শিক্ষাকে কিভাবে যুগোপোযোগী করা যায়, সে সম্পর্কেও ভাল করে জানেন।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.