Breaking News

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে নৈমিত্তিক ছুটি কেনার খরচ সাড়ে ২০ কোটি টাকা

নিউজ ডেস্ক।।

সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক-কর্মচারী বছরে ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করতে পারেন। এই ছুটি ভোগ না করলে কোনো আর্থিক সুবিধা দেওয়ার নিয়ম নেই। এর ব্যতিক্রম রাজধানীর খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। নৈমিত্তিক ছুটি না নেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষক-কর্মচারীদের পুরস্কার দিয়েছে সাড়ে ২০ কোটি টাকার বেশি। ছুটির জন্য দাম চুকানোর এই বদান্যতা ধরা পড়েছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।

ওই তদন্তে ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১১ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সব মিলিয়ে ৩৮২ কোটি টাকার বেশি অনিয়ম পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নৈমিত্তিক ছুটির মূল্য দেওয়া ছাড়াও করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও অর্থ ব্যয়, গাড়ি ও জেনারেটরে অস্বাভাবিক জ্বালানি খরচ, বিধিবহির্ভূত নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, কেনাকাটা, পূর্তকাজসহ বিভিন্ন খাতে এই অনিয়ম হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে গত বছরের এপ্রিল ও জুনে দুই দফায় এই তদন্ত হয়। পরিদর্শন দলে তিনিসহ পাঁচ কর্মকর্তা ছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদন ১৬ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠিয়েছে অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের কারণে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এমপিও বাতিল, পরিচালনা কমিটির (গভর্নিং বডি) সভাপতির পদ শূন্য করাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীরকে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
১৯৬৫ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিলে যাত্রা শুরু করে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। পরে বনশ্রী ও মুগদায়ও শাখা খোলা হয়। এই তিন শাখায় বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে শিক্ষার্থী ২৮ হাজারের বেশি। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সাত শতাধিক।

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান। প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান ১৮ অক্টোবর বলেন, প্রতিবেদনটি এখনো হাতে পাননি। প্রতিবেদন পেলে গভর্নিং বডির সভায় আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

নৈমিত্তিক ছুটির দাম সাড়ে ২০ কোটি টাকা:

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত অর্থবছরে নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ না করার পুরস্কার হিসেবে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিন শাখার শিক্ষক-কর্মচারীদের বিল/ভাউচারের মাধ্যমে মোট ২০ কোটি ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৮ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার বাংলা ভার্সন থেকে ৭ কোটি ১২ লাখ ৭০ হাজার ৪৯৪ টাকা ও ইংরেজি ভার্সন থেকে ২ কোটি ৩২ লাখ ১৬ হাজার ৪৬২ টাকা, মতিঝিল শাখার কলেজ থেকে ২ কোটি ২১ লাখ ৯৪ হাজার ৬৫৪ টাকা, বনশ্রী শাখার বাংলা ভার্সন থেকে ৫ কোটি ৭৯ লাখ ৩৬ হাজার ৪৮০ টাকা, মুগদা শাখার বাংলা ভার্সন থেকে ৩ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৭৫৮ টাকা দেওয়া হয়।

জানা যায়, স্বীকৃতপ্রাপ্ত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালায় নৈমিত্তিক (ক্যাজুয়াল), অর্জিত, চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন, অসাধারণ, কর্তব্যকালীন ও শিক্ষা–এ ছয় ধরনের ছুটির উল্লেখ রয়েছে। এসব ছুটি ভোগ না করলে এর বিপরীতে টাকা দেওয়ার বিধান নেই। রাজধানীর একাধিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে ছুটি না নিলে টাকা দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ১২-১৫ বছর আগে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষক নৈমিত্তিক ছুটি না নিলে পুরস্কার হিসেবে বই অথবা ক্রেস্ট দেওয়া হতো, টাকা নয়। এমন বিধানও নেই।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, নৈমিত্তিক ছুটি না নিলে ভাতার সুযোগ নেই। প্রতিবেদন পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বন্ধেও ব্যয়, বিধিবহির্ভূত নিয়োগ:

করোনার কারণে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সব শাখা বন্ধ থাকলেও বনশ্রী ও মুগদা শাখায় (বাংলা ভার্সন) মুদ্রণ, সাংবাৎসরিক সম্মানী বাবদ ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৫৮১ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ‘বাস্তবসম্মত নয়’।

প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সরকারি বিধি না মেনে শুধু পরিচালনা কমিটির ইচ্ছায়ও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। শিক্ষক নিবন্ধন না থাকা, অবৈধ বিএড সনদ ও বিধিবহির্ভূত নিয়োগ হওয়া ৪৫৯ শিক্ষক ও ৫ কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ নেওয়া ৭৫ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার ৮২২ টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষক নিবন্ধন সনদ না থাকায় ৩৫ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলযোগ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদায় করা অর্থ নিয়ম মেনে ব্যাংকে জমা না রেখে তিন শাখায় ৯৭ কোটি ৯০ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯২ টাকা নগদে খরচ করা হয়েছে। এ জন্য গভর্নিং বডি ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানের ব্যাখ্যা চাওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

সাড়ে ১৪ কোটির হদিস নেই:

প্রতিবেদন মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সাধারণ তহবিলের ১৩ কোটি ৮১ লাখ ১১ হাজার ৫০ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে এবং ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ টাকার হিসাবে গরমিল রয়েছে। এ অর্থ গভর্নিং বডির সদস্যদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, প্রতিষ্ঠানটির তিনটি গাড়ি থাকলেও প্রতি শাখায় তিনটি গাড়ির তথ্য দিয়ে জ্বালানি খরচের বিল করা হয়েছে ৫৩ লাখ ৭১ হাজার ১৮৪ টাকা। তিন গাড়ির মেরামতে ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮২ টাকা খরচেও বিধি মানা হয়নি। পরে দরপত্র ছাড়াই ১২ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কেনা হয়। জেনারেটরের জ্বালানি ও মেরামতে ২২ লাখ ৯৮ হাজার ৬২২ টাকা খরচেও বিধি মানা হয়নি।

পূর্তকাজ ও কেনাকাটায় অনিয়ম:
প্রতিবেদনে রয়েছে, কমনরুম সংস্কার, সীমানাপ্রাচীর, দরজা-জানালাসহ বিভিন্ন পূর্তকাজে বিধি না মেনে কোটেশনের পরিবর্তে নগদ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনিয়মিত ব্যয় করা হয় ৩১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮৪ টাকা। বিধি লঙ্ঘন করে নগদে কেনা হয়েছে ১৭ কোটি ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৯ টাকার মালামাল। বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ছাড়া পণ্য ক্রয় ও পূর্তকাজে ৪৮ কোটি ৯৭ লাখ ৫ হাজার ৬৫৩ টাকা অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বাদ দিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯২ টাকা দিয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়।

গভর্নিং বডিরও সম্মানী ভাতা:
প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক বিধিতে প্রভিশন না থাকলেও গভর্নিং বডির সদস্যরা ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৬ টাকা সম্মানী নিয়েছেন। এ অর্থের বিপরীতে তাঁরা আয়করও দেননি। পরিচালনা কমিটি কন্টিজেন্সি ভাতা বাবদ ৩১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৬ টাকা নিয়েছে। ভালো ফলের জন্য পরিচালনা কমিটিকে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভাতা না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাপ্য বেতন-ভাতার বাইরে অতিরিক্ত উত্তোলন করায় ২২ শিক্ষককে ৩০ লাখ ২৭ হাজার ১৪০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এসবের বাইরে বিভিন্ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও উৎসে কর বাবদ ১৬ কোটি ২৭ হাজার ৩১ টাকা, নিয়মবহির্ভূতভাবে বাড়িভাড়া বাবদ সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের নেওয়া ৪০ লাখ ৭৩ হাজার ৬২৫ টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নৈমিত্তিক ছুটির বিপরীতে ভাতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যাঁরা ভাতা নিয়েছেন, তাঁরা যেমন দায়ী, তেমনি কর্তৃপক্ষও দায়ী। সার্বিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।আজকের পত্রিকা


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

চাকরির নামে লক্ষ টাকা আত্মসাৎ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা

সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের সাহেবখালী সিদ্দিক গাজী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আরিফ …