Breaking News
রুস্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দাস পীযূষ কান্তি। ছবিঃ সংগৃহীত

রুস্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয়: শেষ কর্মদিবসেও প্রধান শিক্ষক পীযূষের অপকর্ম!

আল আমিন হোসেন মৃধা, ঢাকাঃ রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার আশুলিয়া ইউনিয়নের রুস্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দাস পীযূষ কান্তির বিরুদ্ধে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের মৌখিক দায়িত্ব প্রদান, অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে নেওয়া সরকারি বই শেষ কর্ম দিবসে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সামনেই কেজি দরে বিক্রি, শিক্ষার্থীদের সহায়ক বইয়ের নামে গাইড বই কিন্তু বাধ্য করা, অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে অসাধাচারণ, মদদপুষ্ট ব্যক্তিকে টানা ১৫ বছর ধরে সভাপতি বানানোসহ একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মাউশি ডিজি বরাবর লিখিত অভিযোগ ও বিদ্যালয় সূত্র জানা গেছে, চলতি বছরের গত আগস্ট মাসের ১৭ তারিখ প্রধান শিক্ষক দাস পীযূষ কান্তির শেষ কর্মদিবস ছিল। শেষ কর্মদিবসের দিন বিদ্যালয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য দেওয়া সরকারি বই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সামনেই কেজি দরে বিক্রি করে দেন। এছাড়াও প্রধান শিক্ষকের আর্থিক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের সঙ্গী হিসেবে পরিচিত সহকারী শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমানকে জ্যেষ্ঠতার বিধি ভঙ্গ করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব অর্পণ করেন।

একাধিক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর জানুয়ারি মাস আসলেই বিভিন্ন কোম্পানির গাইড বই কিনতে বাধ্য করতেন এই প্রধান শিক্ষক। কোভিডকালে শিক্ষার্থীদের টিকা দিতেও টাকা নিয়েছেন তিনি। এছাড়াও হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হলেও বিদ্যালয়টিতে নেই কোনো হিন্দু পন্ডিত শিক্ষক। জানা গেছে, দাস পীযূষ কান্তি ইচ্ছে করেই হিন্দু পন্ডিত শিক্ষকের চাহিদাপত্র দেননি এনটিআরসিএতে। এছাড়াও বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক শূন্য থাকলেও তিনি চাহিদা পত্র না দিয়ে প্রধান শিক্ষকের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা শিক্ষকদের দিয়ে অন্য একাধিক বিষয়ের ক্লাস নিতে বাধ্য করেন। কথায় কথায় করেন শোকজ।

অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে নেওয়া সরকারি বই শেষ কর্মদিবসে কেজি দরে বিক্রি করছেন প্রধান শিক্ষক। ছবিঃ সংগৃহীত

জানা গেছে, বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন আলী হায়দার। তিনি টানা ১৫ বছর সভাপতির দায়িত্বে। চলতি বছরের গত জানুয়ারি নতুন করে তিনি আবার সভাপতি হন। তবে ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনের প্রোবিধিমালা ২০০৯ অনুযায়ী, নির্বাচিত অভিভাবক সদস্য এবং শিক্ষক প্রতিনিধি ও দাতা সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন সভাপতি। আলী হায়দারকে শিক্ষক প্রতিনিধিরা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচনে ভোট না দেওয়া সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষক তাকে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করে কমিটি গঠন করেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সেই কমিটির অনুমোদন দেয় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সভাপতি আলী হায়দারের যোগসাজসে কাউকে না জানিয়ে বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র সভাপতির নিজ এলাকার বিদ্যালয় পাড়াগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে আর্থিক দুর্নীতি করেন। বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ঠিকাদারের সাথে মিলে ভবন নির্মাণের টাকা প্রধান শিক্ষক আত্মসৎ করেন। গত ৩-৪ বছর যাবৎ ভবনের কাজ অসমাপ্ত পড়ে আছে। যার ফলে শ্রেণি কক্ষ সংকটে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি ফরম পূরণের লক্ষে সরকার কর্তৃক যে টাকা ফরমপূরনকারীর জন্য বরাদ্দ দিয়েছিল সে টাকা তাদেরকে না দিয়ে নিজে ভোগ করেন। বিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচাদি দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাব দীর্ঘ ৪-৫ বছর যাবৎ ক্যাশ খাতায় লিপিবদ্ধ না করে নিজ ইচ্ছা মতো ভাইচার তৈরি করতে বাধ্য করে নিজে সে অর্থ ভোগ করেন। বিদ্যালয়ের অর্থে বিদ্যালয়ের কাজের জন্য কেনা মোবাইল, ল্যাপটপ, ক্যামেরা ইত্যাদি ক্রয়কৃত ডিভাইস নিজে ব্যক্তিগত ভাবে বাসায় ব্যবহার  করেছেন এমনকি অবসরে গেলেও তা বিদ্যালয়ে ফেরত দেননি।

জানা গেছে, গত আগস্ট মাসের ১৭ তারিখ প্রধান শিক্ষক দাস পীযূষ কান্তির চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। তবে এই দিন বিদ্যালয়ের হিসাব নিকাশসহ কোনো কিছুই বুঝে দেননি তিনি। প্রধান শিক্ষক পদে দুই বছর এক্সটেনশন করে পুনরায় একই পদে থাকতে দৌড়ঝাঁপ করছেন তিনি। কখনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কখনও মাউশি কিংবা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। নিজের অনিয়মের সঙ্গী সভাপতিকে সাথে নিয়েই তিনি বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করছেন।

অবসরের পর অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক পদে কাউকে চুক্তি ভিত্তিতে বা পুনঃ নিয়োগ করা যাবে না। যদি তা করা হয়, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ স্থগিতসহ পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি বিদ্যালয় শাখা।

শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী, এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবসরের পর কোনো শিক্ষক-কর্মচারীকে পুনঃ নিয়োগ বা চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই।

এই কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দিচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সহকারি প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব পালন করবেন। সহকারি প্রধান শিক্ষক না থাকলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব পালন করবেন। এর ব্যতয় হলে পুরো প্রতিষ্ঠানটির এমপিও বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জ্যেষ্ঠতার বিধি লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব প্রদান প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, জ্যেষ্ঠতার বিধি ভঙ্গ করে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। সিনিয়র শিক্ষককেই ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। অন্যথায় সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়টির কয়েকজন শিক্ষক বলেন, সদ্য সাবেক প্রধান শিক্ষকের অনিয়মের কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। বিষয়টি অনেকটা একক আধিপত্ত বিস্তার করার মত। নিজের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে তিনি যা খুশি তাই করেছেন। এখন আরও দুই বছর এক্সটেনশন করার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন। নিয়ম অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব না দিয়ে মৌখিক ভাবে তাঁর মদদপুষ্ট শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। ম্যানেজিং কমিটির কাছে আমরা একাধিকবার বার জানিয়েছি কোন লাভ হয়নি। আসলে প্রধান শিক্ষকতো একা একা এগুলো করতে পারেন না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য সাবেক প্রধান শিক্ষক দাস পীযূষ কান্তি শেষ কর্মদিবসে সরকারি বই বিক্রির বিষয়ে বলেন, ১৭ তারিখের ঘটনা আজ কেন বলছেন। যদি ছবি বা ভিডিও আপনার কাছে থাকে তাহলে ১৭ তারিখে কেন বললেন না। এর পর তিনি বলেন আমি আপনাকে দেখে নেব আপনার কত সাহস। এরপর কিছু সময় পর তিনি মুঠোফোনে কল করে বলেন, আপনার নাম কি ? আপনি নিউজ করেন আমি আপনাকে দেখে নিব আপনি কত ক্ষমতাবান।

জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ আলী হায়দার এর মুঠোফোনে কল করে এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সাভার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ শহিদুল হক শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, বিষয়টি মৌখিকভাবে আমিই শুনেছি। আমি তাদের পরামর্শ দিয়েছি বিদ্যালয়ের সম্পদ তছরুপের দায়ে থানায় মামলা করতে। উপজেলা শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হবে। জ্যেষ্ঠতার বিধি লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। জ্যেষ্ঠ শিক্ষককেই ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দিতে হবে।

প্রধান শিক্ষকের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তার হুমকি প্রদানের বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করলে তিনি বলেন, অপকর্মকারীরাই হুমকি দেবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি যদি নিরপরাধী হতে তাহলে নিশ্চয়ই হুমকি দিতেন না।

জানতে চাইলে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি লিখিত অভিযোগটা এখনও হাতে পাইনি। যেহেতু অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্ট। আমি তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিব।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০৯/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

চাকরির নামে লক্ষ টাকা আত্মসাৎ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা

সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের সাহেবখালী সিদ্দিক গাজী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আরিফ …