ফজলে এলাহী: চাকরি পুলিশে, ব্যস্ত স্কুলের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে!
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ মোঃ ফজলে ইলাহী একজন পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক। কর্মস্থল রংপুরে থাকলেও অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন নিজ এলাকার স্কুলের নিয়োগ বাণিজ্য ও সভাপতি দায়িত্ব নিয়ে। তিনি দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ৩নং ফতেজংপুর ইউনিয়নের ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির দাতা সদস্য। বাবা হরমুজ আলী শাহ স্কুলের সভাপতি হলেও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ছেলে মোঃ ফজলে ইলাহী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে স্কুলটিতে অতি গোপনে চার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রার্থীর কাছ থেকে অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এলাকাবাসী ও ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মোঃ ফজলে ইলাহী রংপুরে পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সে কর্মরত থাকলেও তিনি থাকেন প্রতি মাসের অধিকাংশ সময় থাকেন এলাকায়। স্কুলের নিয়োগ বাণিজ্য করা থেকে শুরু করে এলাকায় বিএনপির রাজনীতিতে তিনি সরব। তবে কোন পদ পদবীতে না থাকলেও আগামীতে ফতেহজংপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হবে বলে এখনই সরব এলাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার এক বায়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বলেন, একজন পুলিশে চাকরি করে কিভাবে এতবার বাড়িতে থাকে বুঝি না। দেখেছি অনেককে চার পাঁচ মাসেও ছুটি পাননা। অথচ ফজলে এলাহী অধিকাংশ সময়ই এলাকায় দেখা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কোন কর্মকর্তা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কিংবা কোন সদস্য হতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয়। তবে ফজলে ইলাহী এসবের কিছু ধার ধারেন না। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড থেকে গত বছরের ৩১ অক্টোবর ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি পাস করিয়ে আনেন। এতে নিজে দাতা সদস্য আর তার পিতাকে সভাপতি বানান। এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক একদিন আগে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে পার্শ্ববর্তী বীরগঞ্জ উপজেলার বীরগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এই নিয়োগে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পান ছালেক লতিফ। আর এই নিয়োগের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মোঃ ফজলে ইলাহী।
শিক্ষাবার্তা'র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফতেজংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এনটিআরসিএ বহির্ভুত চারটি পদে (নিরাপত্তাকর্মী, নৈশ্য প্রহরী, আয়া ওপরিচ্ছন্নতা কর্মী) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হরমুজ আলী শাহ এবং তারই ছেলে দাতা সদস্য শাহ ফজলে এলাহী । বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিক ও একটি স্থানীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিধিমালা থাকলেও গোপনে এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে যা স্কুলটির শিক্ষক, এলাকাবাসী কেউই জানেন না।
এদিকে শিক্ষাবার্তা'র হাতে আসা কল রেকর্ডের অডিও বার্তা'য় আর্থিক লেনদেন এবং কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে সে বিষয়ে প্রার্থী এবং বিদ্যালয়টির দাতা সদস্য পুলিশ কর্মকর্তা শাহ ফজলে এলাহীর কথোপকথনে নিয়োগ পাবেন কারা তাদের নাম এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি উঠে আসে।
ঐ অডিও রেকর্ডের সূত্র ধরে জানা গেছে, গোপন এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ পাচ্ছেন নিরাপত্তা কর্মী পদে একই ইউনিয়নের উত্তর পলাশবাড়ী এলাকার মিজানুর রহমানের পুত্র মাহাফুজার রহমান, এবং কিসমত ফতেজংপুর এলাকার মশিউর রহমানের পুত্র নুরজামান, নৈশ্য প্রহরী পদে কিং ফতেহজংপুর এলাকার ছলেমউদ্দিন শাহ'র পুত্র রেজানুল হক, আয়া পদে জোতরঘু এলাকার শ্রী মতি বিত্রিয়া বিশ্বাস, স্বামী শ্রী নারায়ন চন্দ্র এবং একই পদে জোতরঘু এলাকার শ্রী সুমন চন্দ্র রায়ের স্ত্রী শ্রীমতি সাধনা রানী ওপরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে কিং ফতেজংপুর এলাকার ওয়াহেদ আলীর পুত্র মোঃ আনারুল হক। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লেনদেন করে তাদের আবেদনের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।
এদের মধ্যে নিরাপত্তা কর্মী পদে ফজলে এলাহীর আপন খালাতো ভাই মিজানুর রহমানের ছেলে মাহাফুজার রহমান, পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে তাঁর আপন চাচাতো ভাই মশিউর রহমানের ছেলে নুরজামান, আয়া পদে ফজলে এলাহী তাঁর বন্ধুর ভাবী শ্রীমতি বিত্রিয়া বিশ্বাসকে চূড়ান্ত করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের গত ১০ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত বেসরকারি বিদ্যালয়ের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালার পরিপত্রে ২.২ “ক” ধারায় উল্লেখ রয়েছে, শূন্য পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য বহুল প্রচারিত ২ (দুই)টি দৈনিক পত্রিকায় (১টি জাতীয় পত্রিকা এবং ১টি স্থানীয় পত্রিকা) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও সম্ভাব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তির ব্যাপকপ্রচার করতে হবে। এবং ২.৩ এর “খ” ধারায় উল্লেখ রয়েছে, প্রাপ্ত আবেদনের সংক্ষিপ্ত তালিকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নোটিশ বোর্ড/ওয়েব সাইট-এ প্রকাশ করতে হবে।
তবে এই অডিও রেকর্ডের বিষয় অস্বীকার করে দাতা সদস্য পুলিশ কর্মকর্তা শাহ ফজলে এলাহী দাবি করেন, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানিনা, কল রেকর্ড আমার আপনারা কি ভাবে নিশ্চিত হলেন। তিনি দাবি করেন প্রত্যেক স্কুলে নিয়োগ এভাবেই হয়।
এ বিষয়ে রংপুর রিজার্ভ পুলিশের আরওআই মোঃ শাহীনুর ইসলাম তালুকদার বলেম, ফজলে এলাহি আমার এখানে কর্মরত আছে কিনা দাতা সদস্য হবার আবেদন দিছে কি না এ গুল আমাকে দেখতে হবে। আর যদি এলাকা বাসীর কোন অভিযোগ থাকে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব ।
ফজলে এলাহী কর্তৃক নিয়োগ বাণিজ্য, অনুমতি ছাড়া কমিটিতে এবং কর্মস্থলে না থেকে এলাকায় থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর পুলিশ সুপার (বিপিএ) মোঃ ফেরদৌস আলী চৌধুরীও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কোন মন্তব্য করেননি।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৮/০৫/২০২৪