৩য় বিভাগে ডিগ্রী পাসেই ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাহমিনা
আল আমিন হোসেন মৃধা, ঢাকাঃ জ্যেষ্ঠতার বিধি লঙ্ঘন করে সবচেয়ে কম যোগ্যতা থাকা এবং কমিটির আজ্ঞাবহ শিক্ষিকাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলীর ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজের গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে। নিয়োগ পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হচ্ছেন কলেজটির বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাহমিনা বেগম। শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিগ্রি (পাস) ৩য় বিভাগ থাকা তাহমিনা বেগম বিধি অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ৩ নম্বর। নীতিমালা লঙ্ঘন করে কম যোগ্যতা সম্পন্ন এই শিক্ষিকাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছেন কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি ডাঃ মোঃ আরিফুল আমীন।
জানা গেছে, কলেজটির অধ্যক্ষ আসলাম হোসেন ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেলে উপাধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। স্বপন কুমার নাথ গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে অবসরে গেলে গত বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে তিন নম্বর তালিকায় থাকা ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় সবচেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাহমিনা বেগমকে নিয়োগ প্রধান করেন।
শিক্ষাবার্তা'র অনুসন্ধানে জানা গেছে, সহকারী অধ্যাপক তাহমিনা বেগম এসএসসি, এইচএসসিতে ২য় বিভাগে পাস করলেও ১৯৮৫ সালে ডিগ্রী (পাস) ৩য় বিভাগ পেয়ে পাস করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশনে ২০১৯-এর -৪(চ) ধারায় প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদন্নোতি পেতে হলে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ন্যূনতম দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণি, স্নাতক/ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজে প্রভাষক পদে ৫ (পাঁচ) বৎসরের অভিজ্ঞতাসহ প্রভাষক পদে কর্মকালীন সময়ে স্বীকৃতমানের জার্নালে ২ (দুটি) টি প্রকাশনা থাকিতে হইবে।
অন্যদিকে এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো ২০২১ এর ১১.৬ ধারায় প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতার বিধি অনুযায়ী এমপিওভুক্তির তারিখ, একাডেমিক ফলাফল ও অন্যান্য কারিকুলামের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ১৩ ধারায় জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতা নির্ধারণ বিষয়ে বলা আছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতা তাঁদের সংশ্লিষ্ট পদে প্রথম এমপিও.ভুক্তির তারিখ থেকে গণনা করা হবে। এম.পি.ও.ভুক্তি একই তারিখে হলে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঐ প্রতিষ্ঠানের যোগদানের তারিখ বিবেচনা করা হবে। তবে কোনো শিক্ষকের নিয়োগ নিয়মিতকরণ করা হলে নিয়মিতকরণের তারিখ যোগদানের তারিখ হিসেবে গণ্য হবে। যোগদানের তারিখ একই হলে জন্ম তারিখের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ হবে। জন্ম তারিখ একই হলে একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফল বলতে এস.এস.সি./সমমান এবং তদুর্দ্ধ পাবলিক পরীক্ষাসমূহের ফলাফল বুঝাবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশনে ২০১৯-এর ধারা- ৪(ক)-এর ২(১) ও (২) ধারায় বলা আছে, কলেজ অধ্যক্ষ পদ শূন্য হলে অথবা অধ্যক্ষের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে উপাধ্যক্ষ অথবা জ্যেষ্ঠতম পাঁচজন শিক্ষকের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। তবে পাঁচ জন শিক্ষকের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার বিচারে, এমপিওভুক্তি, যোগদান, শিক্ষাগত যোগ্যতা এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিটি গণ্য হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশনে ২০১৯-এর ধারা ১২ তে বলা আছে, বিভাগের জ্যেষ্ঠতম শিক্ষকই বিভাগীয় প্রধান হইবার যোগ্য হইবেন।
জ্যেষ্ঠতার বিধিতে এক নম্বরে থাকা বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শিরীন আক্তার বেগম চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি কলেজটির বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠতার বিধিতে ২য় নম্বরে থাকা হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসবাবিজ্ঞান বিষয়ের উপর ২য় শ্রেণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে। তিনিও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। এই জ্যেষ্ঠ দুই শিক্ষক সকল দিকদিয়ে জ্যেষ্ঠ এবং যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি হলেও তাদেরকে ব্যতিরেকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে জ্যেষ্ঠতার বিচারে তিন নম্বরে থাকা তাহমিনা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কলেজ সূত্র জানায়, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে এবং গভর্নিং বডিকে ম্যানেজ করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদ নিয়েছেন। কাম্য যোগ্যতা না থাকলেও তিনি এখন কলেজের প্রধান কর্তা। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও গভর্নিং বডি ও রাজনৈতিক ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করছে না।
জানা গেছে, সাবেক উপাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে অবসরে গেলেও তাকে প্রতিষ্ঠানটির পাঠদানের স্বার্থ দেখিয়ে পুনরায় সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এক বছরের জন্য এক্সটেনশন করিয়েছি প্রতিষ্ঠানটি। তবে পাঠদানের কথা বলে মেয়াদ শেষে অতিরিক্ত এক বছরের জন্য আনা হলেও তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপদেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ হাজার টাকা সম্মানী নিচ্ছেন এবং সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে ১৫ হাজার টাকা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশনে ২০১৯-এর ধারা- ১৫ (ক) তে বলা আছে, কোন শিক্ষকের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হলে সেদিন থেকেই তিনি অবসরে যাবেন। তবে শর্ত থাকে যে বয়স ৬০ বছর অতিক্রম করলেও গভর্নিং বডি তাঁকে পাঠদানের স্বার্থে এক্সটেনশন করতে পারবেন। সেটা শুধু পাঠদানের স্বার্থে। কিন্তু পাঠদানের স্বার্থ দেখিয়ে স্বপন কুমার নাথকে এক্সটেনশন করলেও তিনি কোন ধরণের পাঠদান না করিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের রুমের পাশের চেয়ারে বসছেন কোন ধরণের ক্লাস তিনি নেননি। এই স্বপন কুমার নাথই গভর্নিং বডিকে প্রভাবিত করেই তাহমিনা বেগমই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে সবচেয়ে যোগ্য দেখিয়ে তাঁকে দায়িত্বে নিয়ে এসেছেন।
জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ পাওয়া তাহমিনা বেগম শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, পরিচালনা পর্ষদ আমাকে সঠিক মনে করেছে তাই দিয়েছে। আমি তো নিজে নিজে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব নিতে পারিনা। তবে আমার স্বামী কেমন ইমেজের রাজনৈতিক ব্যক্তি সেটা আপনারা একটু যাচাই করে দেখবেন। আমার ৩০ বছরের চাকরি জীবনে তিনি কোনদিন আমার কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেনি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী, শুধুমাত্র পাঠদানের স্বার্থে কোন শিক্ষককে অবসরের পরে এক্সটেনশন করা হয়। কিন্তু সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ আপনার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে পাঠদান না করিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এটা তো আমি বলতে পারব না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলতে পারবে।
সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও কলেজটির সাবেক উপাধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিধির আলোকের কারণে সহজেই অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে যাকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তো প্রশাসনিক কাজ বুঝবে না। তাও গভর্নিং বডি আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এক্সটেনশন পেলেন সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এবং পাঠদানের শর্তে মূল দায়িত্ব রেখে উপদেষ্টার বিষয়টি বিধি সম্মত কি'না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন বিধি সম্মত। সম্মানী নেওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, গভর্নিং বডি চাইলে আমাকে ৫ লাখ টাকা করে সম্মানী দিতে পারে।
এ বিষয়ে কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ডাঃ মোঃ আরিফুল আমীন শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি এবং মাউশির বিধি মোতাবেক আমরা গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে নিয়োগ দিয়েছি। এখানে বিধির কোন লঙ্ঘন হয়নি। একজন ডিগ্রি পাস ৩য় শ্রেণি শিক্ষককে দুইটা বিভাগীয় প্রধান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা দুই জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে বাদ দিয়ে কেন তাঁকেই নিয়োগ দেওয়া হলো জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি তো এককভাবে নিয়োগ দেয়নি বিধি মোতাবেক গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত ক্রমে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে কোন অনিয়ম বা ব্যত্যয় হয়নি।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিধি অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ পাঁচ জন শিক্ষকের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেবে গভর্নিং বডি। তবে সেক্ষেত্রে জটিলতা হলে অবশ্যই অন্যান্য অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা মাফিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে নিয়োগ করবে। আর পাঠদানের শর্তে অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকের এক্সটেনশন হলেও অধ্যক্ষের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার প্রসঙ্গে তারা বলছেন এটার সুযোগ নেই। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।
আরও পড়ুনঃ
- মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম: জ্যেষ্ঠতার ৮ নম্বরে থাকা শিক্ষিকাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ
- মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম: ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ!
- মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম: দায়িত্ব ছাড়লেন বিধি ভেঙ্গে নিয়োগ পাওয়া সেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৭/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়