মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম: জ্যেষ্ঠতার ৮ নম্বরে থাকা শিক্ষিকাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ জ্যেষ্ঠতার বিধি লঙ্ঘন করে মদদপুষ্ট শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানাধীন মহিলা কলেজ চট্টগ্রামের গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে। নিয়োগ পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হচ্ছেন সোহানা শারমিন তালুকদার। বিধি অনুযায়ী তিনি জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ৮ নম্বরে রয়েছে। অবৈধ পন্থায় নীতিমালা লঙ্ঘন করে তাকে নিয়োগ দিয়েছেন কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি মাহবুবুল আলম যিনি বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি।
জানা গেছে, কলেজটির সাবেক অধ্যক্ষ তহুরীন সবুর চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি অবসরে গেলে অধ্যক্ষ পদটি শূন্য হলে কলেজটের জ্যেষ্ঠতার ক্রমের আট নম্বরে থাকা সোহানা শারমিন তালুকদারকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব প্রদান করেন গভর্নিং বডির সভাপতি মাহবুবুল আলম।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশনে ২০১৯-এর ধারা- ৪(ক)-এর ২(১) ও (২) ধারায় বলা আছে, কলেজ অধ্যক্ষ পদ শূন্য হলে অথবা অধ্যক্ষের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে উপাধ্যক্ষ অথবা জ্যেষ্ঠতম পাঁচজন শিক্ষকের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশন অ্যাক্টকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ৮ নম্বরে থাকা সোহানা শারমিন তালুকদারকে।
একই শর্তাবলি অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দায়িত্ব দেওয়ার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করার কথা থাকলেও কলেজের গভর্নিং বড়ি সেটি করেনি। শুধু অনিয়ম করে সোহানা শারমিন তালুকদার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষই হননি তিনি নিজে নিজেই ভারমুক্ত হয়েছেন। নিজেকে অধ্যক্ষ হিসেবে দাবি করে ব্যানারে অধ্যক্ষ লিখছেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে কলেজটিতে 'আমার চোখে বঙ্গবন্ধু' শিরোনামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নিজেকে অধ্যক্ষ হিসেবে দাবি করে ব্যানারেও লিখেছেন তিনি। এছাড়াও সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারেও তিনি সরাসরি অধ্যক্ষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
কলেজটির অধ্যক্ষের বিষয়ে জানতে প্রথমে চলতি বছরের ১৩ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে একটি চিঠি আসে কলেজে। কিন্তু এই চিঠির কোনো হদিস মেলেনি। জানা গেছে, কলেজের ইমেইলে আসা এই চিঠি গায়েব করে দেন বিধি লঙ্ঘন করে দায়িত্ব পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোহানা শারমিন তালুকদার। সেই চিঠির কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। এরপর গত ১ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ ইমেইলে আরেকটি চিঠি দেওয়া হলেও সেই চিঠির বিষয়ে কাউকে জানাননি সোহানা শারমিন তালুকদার। গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে আসা এই চিঠিটিও গায়েব করে দেন তিনি। পরবর্তীতে বিভিন্ন মারফতে চিঠিটা হাতে পায় অন্যান্য শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সভাপতি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনুমোদনক্রমে ভারপ্রাপ্ত কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা স্বাক্ষরতি চলতি মাসের এক তারিখে গভর্নিং বডির সভাপতিকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মহিলা কলেজ চট্টগ্রামে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকুরীর শর্তাবলী রেগুলেশন (সংশোধিত) ২০১৯-এর ধারা ৪ (ক)-এর ২(i) ও (ii) ধারা মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে উপাধ্যক্ষ/ জ্যেষ্ঠ্যতম ০৫ (পাঁচ) জন শিক্ষকদের মধ্য হতে যে কোন একজনকে দায়িত্ব প্রদান করে, দায়িত্ব প্রদান সংক্রান্ত রেজুলেশন, দায়িত্ব প্রদান সংক্রান্ত পত্রের কপিসহ আগামী ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহিত করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হলো।
তবে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম পাঁচ শিক্ষকের মধ্যে একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চিঠি দিলেও সেটি মানেনি গভর্নিং বডি।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানে অনিয়মের বিষয়ে গভর্নিং বডির সভাপতিকে একাধিকবার জানানো হলেও তিনি কোনো কর্ণপাত করেননি জানিয়ে কলেজটির একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, গভর্নিং বডি নিয়ম না মেনে গত ১ ফেব্রুয়ারি সোহানাকে দায়িত্ব দিয়েছে। তাকে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনসহ বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি রেগুলেশনে (সংশোধিত) ২০১৯-এর শর্তাবলি মানা হয়নি।
জ্যেষ্ঠতার তালিকায় থাকা সহকারী অধ্যাপক মর্জিয়া চৌধুরী শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কি বলব নিয়ম অনুযায়ী কিছুই হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দুই দুই বার চিঠি দিলেও গভর্নিং বডির সভাপতি একটি সভাও আহ্বান করেনি। আমরা মনে করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিষয়টি শক্তভাবে হ্যান্ডাল করা উচিত।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, কলেজটিতে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে ইতিমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কলেজ গভর্নিং বডি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগের পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে বিধিমোতাবেক অধ্যক্ষ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের এক বছরের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বাক্ষরযুক্ত কাগজপত্র ও কার্যবিবরণী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত অথবা গ্রহণযোগ্য হবে না। ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব নিয়ে ছয় মাস অতিবাহিত করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু জানাননি ভারপারপ্ত অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলেও এই নিয়োগ বৈধ হবে না বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা। ঐ কর্মকর্তা জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম বহির্ভুত কোন কর্মকাণ্ড চালালে কাউকে দায়িত্ব দিলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঐ ব্যক্তি কাউকে নিয়োগ দিলে সেটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করবে না।
জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে সবার ওপরে থাকা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মুনিরা চৌধুরী বলেন, গভর্নিং বডির মিটিংয়ে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ১ নম্বরে থাকা শিক্ষককে অধ্যক্ষ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরে দেখি সেটি পাল্টে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ৮ নম্বরে থাকা সোহানাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ৮ নম্বরে থাকা একজনকে এনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ায় আমরা আশ্চর্য হয়েছি। সে বিষয়ে আমরা গভর্নিং বডির সভাপতিকে জানিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। চিঠির শর্ত অনুযায়ী ১০ কার্যদিবস পার হলেও এখন পর্যন্ত গভর্নিং বডি কোনো মিটিং আহ্বান করেনি।'
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা বলেন, এই অনিয়মের বিষয়টি জানার সাথে সাথেই আমরা গভর্নিং বডিকে চিঠি দিয়েছি। তালিকায় থাকা পাঁচ জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে থেকে একজনকে নিয়োগ দিয়ে দশ কার্যদিবসের মধ্যে জানানোর কথা থাকলেও গভর্নিং বডি আমাদের কিছু জানাননি। বিষয়টি নিয়ে অচিরেই আমরা পদক্ষেপ নিব।
কলেজটির সাবেক অধ্যক্ষ তহুরীন সবুর শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আমি ৩৪ বছর কলেজটিতে শিক্ষকতা করেছি। ১৩ বছর উপাধ্যক্ষ-অধ্যক্ষ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছি। চলে আসার পরে কলেজটির যা অবস্থা সেটা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে। নিয়ম অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে আমি সহকারী অধ্যাপক মুনিরা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সুপারিশ করেছিলাম এবং দ্রুত অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়ার জন্য সভাপতিকে বলেছিলাম। কলেজের কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নের কার্যক্রম নিয়ে মতবিরোধ থাকায় মুনিরা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব না দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হলে আমি জ্যেষ্ঠতার তালিকা থেকে অন্য চারজনের থেকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বললেও সভাপতি জ্যেষ্ঠতার তালিকায় আট নম্বরে থাকা সোহানা শারমিন তালুকদারকে নিয়োগ দেন। বিষয়টি দুঃখজনক।
অনিয়মের কথা স্বীকার করে এ বিষয়ে গভর্নিং বডির সভাপতি মাহবুবুল আলম স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ‘ আমি এত কিছু জানতাম না আমার কাছে একটি কাগজ নিয়ে এসে শুধু স্বাক্ষর নিয়েছে। তবে যেহেতু অনিয়মের প্রসঙ্গটা আসছে। আমি দ্রুত এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা দুই টি চিঠিই শিক্ষক সোহানা শারমিন তালুকদার গায়েব করেছেন। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে কাজ করব।
গভর্নিং বডির সভাপরির এই স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়মের বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর মোঃ জাহেদুল হক শিক্ষাবার্তা'কে জানান, এই কমিটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেয়। আমাদের এখানে নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে যদি কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসে সেটা আমরা তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।
নিয়ম লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পাওয়া সোহানা শারমিন তালুকদারকে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। কেউ অভিযোগও করেননি। তবে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২০/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়