মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম: ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ!
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ 'মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম: জ্যেষ্ঠতার ৮ নম্বরে থাকা শিক্ষিকাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ' শিরোনামে গত রবিবার (২০ আগস্ট) শিক্ষাবার্তা'য় সংবাদ প্রকাশিত হবার পর পরই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে এবং বিষয়টিকে উল্টোদিকে মোড় নেওয়াতে উঠে পড়ে লেগেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি পুরোপুরি লঙ্ঘন করে দায়িত্ব নেওয়া মহিলা কলেজ চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোহানা শারমিন তালুকদার।
দীর্ঘ ৩৪ বছর কলেজটিতে চাকরি করা এবং ১৩ বছর কলেজটিতে উপাধ্যক্ষ-অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা কলেজটির সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ তহুরীন সবুরকে জামায়াত-বিএনপিপন্থি ট্যাগ দিয়ে প্রোপাগ্যান্ডা চালানো, নীতিমালা লঙ্ঘন করে দায়িত্ব নেওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলা দুই জন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানী করছেন মর্মে অভিযোগ করা এবং মৌখিক নোটিশ প্রদান ত্বত্ত্ব হাজির এবং কলেজ প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর মুরাল করার ইচ্ছে পোষণ করায় জামায়াত-বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা তার বিরোধীতা করছেন মর্মে নানা ধরণের রিউমার ছড়ানোর চেষ্টা করছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোহানা শারমিন তালুকদার। এছাড়াও জ্যেষ্ঠ প্রথম পাঁচ শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যা এবং অনিয়মিত উল্লেখ করে তিনিই যোগ্য বলে দাবি করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক অধ্যক্ষ তহুরীন সবুর এর বাবা বিশিষ্ট আইনজীবী মরহুম আবদুস সবুর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তহুরীন সবুরের মেজ ভাই বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি বোরহানউদ্দিন। ছোট ভাই এডভোকেট এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন চট্টগ্রাম বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক। তহুরীন সবুর এর মা বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মমতাজ সবুর। তার নামে চট্টগ্রাম একাডেমিতে একটি পুরষ্কার প্রচলিত আছে। চলতি বছর মমতাজ সবুর সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন একুশে পদ্কপ্রাপ্ত বরেণ্য কবি ও কথাশিল্পী কামাল চৌধুরী (যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্যসচিব ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি বাস্তবায়নের প্রধান সমন্বয়ক)। তহুরীন সবুর নিজেও একজন লেখক। তার প্রকাশিত অনেক গ্ৰন্থ রয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকেন।
সাবেক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যা অভিযোগসহ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগ এনেও পার পাচ্ছেন না ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোহানা শারমিন তালুকদার। বিধি লঙ্ঘন করে নিয়োগ পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশে গভর্নিং বডি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এবং গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য।
জানা গেছে, কলেজটির সাবেক অধ্যক্ষ তহুরীন সবুর চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি অবসরে গেলে গত ১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। এদিকে ছয় মাসের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগের নিয়ম থাকলেও তা মানছে না কলেজ কর্তৃপক্ষ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে বলা আছে, কোনো কলেজে অধ্যক্ষের পদ খালি হলে উপাধ্যক্ষ বা জ্যেষ্ঠ পাঁচ শিক্ষকের মধ্যে একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। ছয় মাসের মধ্যে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুযায়ী প্রথম পাঁচজনের একজনকে নিয়মিত অধ্যক্ষ নিয়োগের নিয়মও রয়েছে।
গত ১ আগস্ট অধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়ে জানতে চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গভর্নিং বডির সভাপতি বরাবর একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। চিঠিতে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ কাকে দেওয়া হয়েছে, এ সংক্রান্ত রেজল্যুশন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করতে বলা হয়। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাবার্তায় সংবাদ প্রকাশিত হবার পর নির্ধারিত সময় অতিক্রম হলেও গতকাল ২২ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ইমেইল বার্তায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ সংক্রান্ত চিঠি পাঠান গভর্নিং বডির সভাপতি।
তবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোহানা শারমিন তালুকদার শিক্ষাবার্তা'র কাছে দাবি করেন, এই চিঠি অনেক আগেই পাঠানো হয়েছে। ইমেইল বার্তায় এবং হার্ড কপিতে। তবে কেন এত দেরিতে ইমেইল পৌছালো তিনি তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আমরা গতকাল ইমেইল বার্তা'য় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশনের কপি পেয়েছি আগে পাঠানো হয়নি। তিনি আরও জানান, বিষয়টি বিধি মোতাবেক হয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, কলেজে অধ্যক্ষ পদ শূন্য হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে উপাধ্যক্ষ অথবা জ্যেষ্ঠতম পাঁচজন শিক্ষকের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশনের কপিসহ যাবতীয় কাগজপত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো এবং দায়িত্ব প্রাপ্তির ছয় মাসের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৮ নম্বরে থাকা শিক্ষককে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই যদি জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পূর্বের সাত জন শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনে অপারগত না জানান। ছয় মাস অতিক্রম করলো দায়িত্ব প্রাপ্তির অথচ আমরা কিছুই জানিনা। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র শিক্ষাবার্তা'কে জানান, আজ বুধবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মহিলা কলেজ চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির সভাপতিকে জানানো হয়েছে দ্রুত জ্যেষ্ঠতার বিধি মেনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগের আয়োজন করতে। অন্যথায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, কলেজটির গভর্নিং বডির সভায় দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতে বলা হয়েছে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব প্রদানের কথা আজ মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। এরপরও যদি গভর্নিং বডি বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা না নেয় তাহলে গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ।
কলেজ ও গভর্নিং বডি সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৭ আগস্ট গভর্নিং বডির সভা আহ্বান করা হয়েছে। যেখানে প্রধান আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে দায়িত্ব হস্তান্তর। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরে একই সভায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ এবং তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিতকরণ এবং অধ্যক্ষ নিয়োগ সংক্রান্ত আলোচনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গভর্নিং বডির এক সদস্য শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, নিয়োগ কিভাবে হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলবনা। যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক নিয়োগ হয়নি তাই গভর্নিং বডির সভায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব হস্তান্তরের পর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নতুন ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব প্রদান সংক্রান্ত কার্যাবলি ঠিক করা হয়েছে। আশাকরি এরপর আর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা লাগবে না।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে গভর্নিং বডির জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চট্টগ্রামের উপাচার্য অধ্যাপক ড. .এফ.এম আওরঙ্গজেব শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। গভর্নিং বডির সভায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপনি সভাপতির সাথে কথা বলেন বিস্তারিত উনি ভালো বলতে পারবেন।
শিক্ষাবার্তা'র পক্ষ থেকে একাধিকবার গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্বে থাকা এফবিসিসিআই'এর সভাপতি মাহবুবুল আলমের মুঠোফোনে গত তিন দিন ধরে একাধিকবার কল করে এমনকি মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান শিক্ষাবার্তাকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৩/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়