এইমাত্র পাওয়া

বাংলাদেশে ‘‘শিক্ষকতা” একটি মারাত্মক অভিশাপ; শিক্ষকরা “জাতীয় ঢাকের কাঠী”

মো: দ্বীন ইসলাম হাওলাদার ।।

শিক্ষক সুশিক্ষত জাতি গড়ার কারিগর। তাই শিক্ষকদেরকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন বাদশা আলমগীর। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকরা মন্ত্রী/বিচারপতির সমাসীন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থান অনেকাংশে খ্যাতিমান রম্য রচনাকার সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘‘পাদ্টীকা’’ গল্পের অবহেলিত পন্ডিত মশাই বা বাংলা সিনেমার হতদরিদ্র ও উপেক্ষিত সামান্য স্কুল মাষ্টারের মতোই। আর্থিক ভাবে সরকার শিক্ষকদের অবস্থার উন্নতি মন্থর গতিতে চালালেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে তারা নির্যাতিত ও অভিশপ্ত রয়েই গেছেন।

 

আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দুটি ধারায় বিভক্ত সরকারি ও বেসরকারি। তবে এখনো ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষত হয় বেসরকারি (এমপিও/ননএমপিও) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। হাজার হজার ননএমপিও শিক্ষক যুগযুগ ধরে বিনা বেতনে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। এমপিও নিয়ে চলছে নানা টালবাহানা আর কালক্ষেপন। ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে নানা ছল ছুতোয়। অসুস্থ বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রী নয়ে অর্ধাহারে অনাহারে তাঁদের দিন কাটছে। জুটছেনা বৃদ্ধ মা বাবার ঔষধ। আর যারা এমপিও ভুক্ত তাদেরকে মাসিক বড়িভাড়া দেয়া হয় ১০০০/- টাকা এবং মেডিকেল ভাতা ৫০০/- টাকা।

 

টাইম স্কেল নিয়ে চলছে নানা টালবাহানা। উৎসব ভাতা মূল স্কেলের ২৫%। এই সামান্য কটা টাকা পাওয়ার পর একজন শিক্ষক মারাত্মকভাবে মুশকিলে পরেন। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, মা- বাবা, ভাই-বোন, শশুর-শাশুরী, শ্যালক- শ্যালিকা কাকে কি দিবেন হিসাব মেলাতে পারেন না। এ অবস্থা ঈদ-উল-ফিতরে। আর কোরবানীর ঈদেও বোনাসের টাকায় এক ভাগের ১৩ অংশ হয় না। তাই, ঈদ এলে শিক্ষকরা আনন্দের পরিবর্তে মারাত্মক মানসিক যন্ত্রনায় ভোগেন। সারাদিন প্রতিষ্ঠানে, তারপরে পরিবারের ভরন পোষনের জন্য বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে প্রাইভেট পড়ানোসহ নানা কাজ করতে হয় তাদেরকে।

 

তদুপরি তাদের উপর চাপানো হয় ভোটার তালিকা করন, তালিকা হালনাগাদ করন, আদমসুমারি,পশুসুমারি, বৃক্ষসুমারি, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের কে শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারকারীদের সংখ্যা নিরূপন, মশা দমনে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করন অভিযান, শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপার, বয়োসন্ধিকালে করনীয় ও বর্জনীয় কাজে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ আরও কত কি। এমনকি ছাত্রীদেরকে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহের কাজও শিক্ষকদেরকে করতে বাধ্য করা হয়। হয়তো এগুলো করতে গিয়ে তারা ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন।

সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় হলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, জাতীয় বা স্থানীয় দিবস সমুহে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে র‌্যালি ও সমাবেশে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা হয়। অথচ এগুলো করা উচিৎ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সমুহের। আরো বাধ্য করা হয় মেম্বর/চেয়ারম্যান/এমপি/মন্ত্রীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের র‌্যালি সমাবেশে হাজির হতে। আবার প্রভাবশালী রাজনীতিকদের আগমনেও রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাদেরকে উষ্ণ অর্ভ্যর্থনা জানাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে রাস্তার দু’ধারে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়।

 

এর চেয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার আর কী হতে পারে ? কখনো বা প্রভাবশালী রাজনীতিকদের মৌখিক আদেশে, কখনোবা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আদেশ জারি হয়। অন্যকোন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়বন্ধতা না থাকলেও শিক্ষকদের মুক্তি নাই। কেউ অসুস্থ হলে বা কোন নিকটাত্মীয়, মারা গেলেও র‌্যালি সমাবেশ থেকে রেহাই মেলা মুশকিল। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কোনো রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি হলে তো কথাই নাই।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছুটির তালিকা কাগজ আর অনলাইনে। তারা কতটা ভোগ করতে পারেন ? প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে আর শিক্ষকরা নির্যাতিত হতেই থাকবেন। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটিও ১ দিন। কেন শিক্ষকদের প্রতি এই অবিচার ? তারা কি কোনো দিন এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন না ? কেন শিক্ষকরা “জাতীয় ঢাকের কাঠী’? কিছু আমলারা তাদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে ও সরকারকে খুশি করতে নতুন নতুন দিবসের সূচনা করে।

 

তা প্রতিপালনে প্রজ্ঞাপন জারি করে নিজেরা ছুটি ভোগ করেন। আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা বাদ দিয়ে এমনকি সরকারি ছুটির দিনেও র‌্যালি ও সমাবেশে নিহিত থাকেন। সরকারি প্রজ্ঞাপনের পাশাপাশি এনজিও গুলোও সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীতে সন্নিবেশিত হতে বাধ্য করেন।

 

এত বেশি দিবস-পালন, এত বেশি র‌্যালি, এত বেশি সমাবেশ যেমন শিক্ষাকে ধ্বংশ করছে; তেমনি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা পেছনে ফেলছে। যা উপলব্ধি করায় ক্ষমতা আমাদের অনেকেরই নাই। সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষভাবে অনুরোধ করবো, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা ব্যতিত অন্যান্য কর্মকান্ড থেকে মুক্ত রেখে ও শিক্ষকদেরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে একটি সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ণে সুব্যবস্থা নেয়ার।

লেখক-

প্রভাষক
দুমকি ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসা
দুমকি, পটুয়াখালী।


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.