পূর্বাশা পৃথ্ব্বী
বর্তমানে ‘উন্নয়ন’ শব্দটির সঙ্গে টেকসই শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সামিটে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস নামে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার পর উন্নয়ন বিষয়টি নতুন আঙ্গিকে পরিচিতি লাভ করেছে। অন্যান্য স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সচেষ্ট হয়ে এগিয়ে চলেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও চিকিত্সা, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রসরতা সত্যিই প্রশংসনীয়।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ লক্ষ্যমাত্রাটি হলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাশের হার যেমন বেড়ে চলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন পরীক্ষাগুলোতে প্রতিযোগিতাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় দেশের সবগুলো শিক্ষা বোর্ডে গড় পাশের হার ৭৩.৯৩ শতাংশ। অর্থাত্ শিক্ষার হারও ক্রমশ বাড়ছে । তবে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার নিজের ও পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবায় এ শিক্ষা কী প্রকৃত অর্থেই “মানসম্মত” বিশেষণ ব্যবহারের উপযোগী হয়েছে?
সুস্থ শরীর ও প্রফুল্ল মন নিয়ে জীবনযাপনের জন্য খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ পাঠ্যপুস্তকের খেলাধুলা অংশের দুটি অধ্যায় হলো ‘দলগত খেলা’ এবং ‘অ্যাথলেটিকস ও সাঁতার’। দলগত খেলা অধ্যায়ে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, হকি, হ্যান্ডবল প্রভৃতি খেলার তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে। কোনো খেলায় মাঠের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ কতটুকু হবে, খেলার নিয়মকানুন, খেলার বর্ণনা প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। শুধু শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান নয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির পাঠ্যও শিক্ষার্থীদের জন্য নিতান্তই একটি না বুঝে মুখস্থ করার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামে শহরে সবার হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন থাকলেও ওয়েব সাইট তৈরি, সি প্রোগ্রামিং প্রভৃতি বিষয় হাতেকলমে শেখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। আর শিল্পবিপ্লবের এ যুগে প্রযুক্তিগত দক্ষতায় শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করে তুলতে না পারলে আমাদের জাতির ভবিষ্যতের চিত্র খুব সুখকর নয়। এজন্য পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যা লিখতে বাধ্য করার পূর্বে এই বিষয়ে প্রচুর পরিমাণে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পঞ্চম লক্ষ্য হলো ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়ন করা’। ষষ্ঠ লক্ষ্যমাত্রাটি হলো, ‘সবার জন্য পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সহজপ্রাপ্যতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।’
ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ধনী-দরিদ্র ভেদে পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধায় বৈষম্য রয়েছে। লৈঙ্গিক ভিত্তিতেও এই ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। ইউনিসেফের ২০১৩ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ধনীদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের অনুন্নত স্যানিটেশন ব্যবহারের হার ১০ গুণ বেশি। গ্রামের মাত্র ৩৩ শতাংশ এবং শহরে ৬০ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার শিশুদের মল নিরাপদ স্থানে অপসারণ করে। বাংলাদেশে ৮৪ শতাংশ বিদ্যালয়ে টয়লেট আছে, যার মাত্র ২৪ ভাগ উন্নত, ব্যবহারোপযোগী ও পরিচ্ছন্ন। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতার ঘাটতির কারণে বছরে ৪২০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। এই অর্থ বাংলাদেশের জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশের সমান। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ‘পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করলে তার প্রায় ২ দশমিক ৩ গুণ বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে।’ ঢাকা ও অন্য শহরগুলোতে বৃষ্টির দিনে জলাবদ্ধতা ও জলজটের জনদুর্ভোগ খুবই পরিচিত দৃশ্য।
গত দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে টেকসই উন্নয়নের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা পিছিয়ে আছি। এ অনগ্রসরতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে উচ্চহারের জিডিপি ও আয় থাকা সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রবাহ মন্থর ও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা যায়। তাই দেশের প্রত্যেক নাগরিককে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের পাশাপাশি প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ আন্তরিকভাবে কাম্য।
লেখক :শিক্ষার্থী, উন্নয়ন অধ্যয়ন,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.