এইমাত্র পাওয়া

“এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে: লালনের প্রশ্ন আজও জাগ্রত”

।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।। 

“এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে,
যেখানে মানুষে মানুষ ধর্মে বিভেদ না রবে”—

লালন ফকিরের এই অমর পঙ্‌ক্তি আজও আমাদের কানে বারবার ধ্বনিত হয়। শত বছর পেরিয়ে গেলেও তার এই প্রশ্নের জবাব আজও পুরোপুরি মেলেনি। কারণ আমাদের সমাজে এখনো গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে দুর্নীতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় বিভাজন ও সামাজিক বৈষম্য। মানুষ মানুষকে ভালোবাসার বদলে বিভক্ত করে ধর্মে, বর্ণে, রাজনৈতিক পরিচয়ে কিংবা সামাজিক অবস্থানে। লালন যে মানব সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন—সেখানে ভালোবাসা ও ন্যায়ের জয় হবে, আর কুসংস্কার, ভেদাভেদ ও দুর্নীতি হার মেনে পিছু হটবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সমাজে এখনো সেই আলো সম্পূর্ণভাবে ফুটে ওঠেনি।

লালন ফকির ছিলেন একজন মুক্তচিন্তার সাধক ও মানবতাবাদী দার্শনিক। তিনি কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করতেন না। তার কাছে মানুষই ছিল সবচেয়ে বড় ধর্ম। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন—“মানুষ বড় না ধর্ম বড়?” লালনের দর্শনে মানবতা, ন্যায্যতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল মূল কথা। তার গানে বারবার উঠে এসেছে এই আহ্বান—

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।।

————————————–

—————————————–

এই মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই শূন্যকার।
লালন বলে মানুষ আকার
ভজলে তারে পাবি।।

তিনি এমন এক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে মানুষে মানুষে থাকবে না ভেদাভেদ, বৈষম্য, নিপীড়ন বা শোষণ। সমাজে থাকবে না দুর্নীতির বিষবাষ্প, থাকবে না অন্ধ বিশ্বাস বা কুসংস্কারের অন্ধকার। এই মানবতাবাদী সমাজ গড়ার বার্তা তিনি দিয়েছিলেন সহজ-সরল ভাষায়, যাতে সাধারণ মানুষও তা বুঝতে পারে।

দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু রাজনীতি বা প্রশাসন নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার, চাকরি, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত দুর্নীতির ছায়া ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে প্রায় প্রতি বছরই দেখা যায়, দেশে দুর্নীতির মাত্রা কমছে না বরং নানা রূপে আরও বিস্তৃত হচ্ছে।

দুর্নীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের। তারা সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়, ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করে বছরের পর বছর, স্বাস্থ্যসেবা পেতে হয়রানির শিকার হয়। অথচ লালনের দর্শনে যে সমাজের কথা বলা হয়েছে, সেখানে এমন অবিচার বা অন্যায়ের কোনো স্থান নেই।

দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। যখন সমাজে ন্যায়-অন্যায় ভেদ করার মানসিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। লালনের গান তাই আজকের সমাজের জন্য এক সতর্কবার্তা—মানুষকে নিজের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে, নইলে মানব সমাজের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে।

দুর্নীতির পাশাপাশি আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে কুসংস্কার। শিক্ষা ও বিজ্ঞান যতই অগ্রসর হোক, এখনো সমাজে কুসংস্কারের শেকল বেশ শক্তভাবে বাঁধা। কোনো অসুখ হলে অনেক মানুষ এখনো ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ঝাড়ফুঁক বা তাবিজে বিশ্বাস করে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ এখনো ‘অলৌকিক শক্তি’ বা ‘অশুভ ছায়া’কে দায়ী করে। মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে কুসংস্কার, বিয়েতে পণপ্রথা, জন্ম ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নানা অবৈজ্ঞানিক আচার—এসব আমাদের সমাজে এখনো বহুল প্রচলিত।

লালন ফকির নিজেই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সমাজের বিভাজনকে আঘাত করেছিলেন গানের মাধ্যমে। তার মতে, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস মানুষকে মুক্তি দেয় না—বরং অন্ধকারে বন্দি করে রাখে।

লালন ফকির হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান—কোনো ধর্মের গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষে মানুষে বিভাজন শুধু কৃত্রিম প্রাচীর। তিনি বলেছিলেন—

 “মোটা কাপড়ে গরিব, পাতলা কাপড়ে ধনী—
মানুষ এক, ভেদ করে কোনি?”

আজকের সমাজে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের নামে হিংসা, সহিংসতা ও বিদ্বেষ বাড়ছে। মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, কারও ওপর চলছে নির্যাতন। অথচ লালন যে সমাজের কথা বলেছিলেন, সেখানে কোনো ধর্মীয় বিভাজনের স্থান নেই—সেখানে সব মানুষ সমান মর্যাদায় বাঁচবে।

বর্তমান সমাজে অনেক সময় রাজনীতি মানুষের কল্যাণের বদলে ব্যক্তিস্বার্থে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা দখল, প্রভাব খাটানো, আর্থিক লুটপাট—এসব রাজনীতির সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে। ফলে সমাজে ন্যায়পরায়ণতা হারিয়ে যাচ্ছে, নৈতিকতা অবমূল্যায়িত হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেও একই চিত্র। ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব। সম্পদের অসম বণ্টন সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। অথচ লালনের গান বলে—মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসে, যদি ভেদাভেদ দূর করে, তাহলে এমন বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

দুর্নীতি ও কুসংস্কারের অন্যতম বড় কারণ হলো শিক্ষার ঘাটতি ও সচেতনতার অভাব। অনেক সময় মানুষ বুঝেই না যে ঘুষ দেওয়া বা নেওয়া অপরাধ। আবার কুসংস্কারকে ‘ধর্মীয় আচার’ ভেবে আঁকড়ে ধরে। এই অবস্থায় সচেতনতা তৈরি না হলে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়।

লালন ফকির তার গানে জাগ্রত চেতনার কথা বলেছেন। মানুষকে বলেছিলেন নিজের ভেতরের মানুষকে চিনতে। তার দর্শনে আত্মজ্ঞান অর্জনই হচ্ছে মুক্তির পথ। আধুনিক ভাষায় বললে—সুশিক্ষা ও সচেতন নাগরিক সমাজ গঠন ছাড়া দুর্নীতি ও কুসংস্কার দূর করা যাবে না।

আজকের সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে যেমন ফারাক বাড়ছে, তেমনি সামাজিক মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও গভীর বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। কোনো কোনো শ্রেণি মনে করে তারা অন্যদের চেয়ে ‘উচ্চতর’। লালন এই ভেদাভেদকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন—

 “জাতে-পাতে ভেদাভেদ,
এ কোন ধর্মের প্রথা রে!”

তার এই আহ্বান কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক অর্থেও গভীর। তিনি এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে মানুষের বিচার হবে না জাত, ধর্ম, লিঙ্গ বা সম্পদের ভিত্তিতে; বিচার হবে শুধু মানুষের গুণে ও চরিত্রে।

লালন ফকির কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন না। তবু তার দর্শন সমাজ পরিবর্তনের জন্য শক্তিশালী দিকনির্দেশনা দেয়।
তার ভাবধারায় যে সমাজ গড়ে উঠতে পারে, তার বৈশিষ্ট্য হতে পারে— ধর্ম, জাতি বা বর্ণ নয়—মানুষই হবে সবার আগে।দুর্নীতিকে সমাজ থেকে অবৈধ ঘোষণা করে বাস্তবিক শাস্তির ব্যবস্থা।শিক্ষা ও বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে মানুষকে মুক্তচিন্তার পথে নিয়ে আসা।সব ধর্মের মানুষকে সমান মর্যাদায় দেখা, ধর্মীয় বিদ্বেষ বন্ধ করা।ধনী-গরিব বৈষম্য কমিয়ে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন।

লালনের স্বপ্নের সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু রাষ্ট্র নয়, নাগরিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। দুর্নীতি দেখে চুপ না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। কুসংস্কার ভাঙতে হবে যুক্তি ও শিক্ষার আলোয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে সম্মিলিতভাবে।

প্রতিটি পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে এই পরিবর্তনের মূল কেন্দ্র। শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝে বড় হয়, তবে ভবিষ্যতের সমাজ হবে অনেক আলোকিত।

অনেকে মনে করে লালনের গান শুধু ‘ভক্তি সংগীত’—কিন্তু বাস্তবে তা নয়। তার গান সমাজ বদলের চেতনার গান। দুর্নীতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় ভেদাভেদ আজ যেমন জ্বলন্ত সমস্যা, লালন তার সময়েও তা অনুভব করেছিলেন। তাই তার গান আজও সমান প্রাসঙ্গিক, এমনকি আরও বেশি প্রয়োজনীয়।

লালনের স্বপ্নের সমাজ হঠাৎ করে গড়ে উঠবে না। এটি গড়ে তুলতে হবে ধীরে ধীরে, মানুষের ভেতর থেকে। দুর্নীতিকে ঘৃণা করতে হবে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তির লড়াই চালাতে হবে, ধর্মীয় ভেদাভেদ দূর করে ভালোবাসার সমাজ গড়তে হবে।

যে দিন আমাদের সমাজে মানুষ হবে ধর্ম, বর্ণ ও সম্পদের ঊর্ধ্বে—সেদিনই লালনের প্রশ্নের জবাব মিলবে।“এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে”—

হয়তো সেদিনই যখন আমরা সবাই মানুষ হবো,
শুধু পরিচয়ে নয়, চেতনায়ও।

লেখা: শিক্ষক ও গবেষক।। 

শিক্ষাবার্তা /এ/১৮/১০/২০২৫

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading