মুহাম্মদ জহিরুল আলম।।
মহান আল্লাহ যখন থেকে সৃষ্টির সূচনা করেছেন তখন থেকেই আমাদের ১২টি মাস দান করেছেন। তার মাঝে চারটি মাসকে পবিত্র ও সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন। মাস চারটি হলো-রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই মাসগুলোর সংখ্যা আল্লাহর কাছে বারো, আর তা সুনির্দিষ্ট রয়েছে আল্লাহর কিতাবে সেদিন থেকে, যেদিন তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন; এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মপথ। সুতরাং এ মাসগুলোর ব্যাপারে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। (সূরা আত তাওবাহ ৯ : আয়াত ৩৬)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘চারটি মাস তথা রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম মাসকে আল্লাহতায়ালা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। এ মাসগুলোর মর্যাদা আল্লাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি এ মাসগুলোর পাপকর্মকে কঠিন পাপ হিসাবে গণ্য করে থাকেন। এ মাসগুলোর নেক কাজগুলোর প্রতিদানও তিনি অধিক পরিমাণে দিয়ে থাকেন।’ (তাফসিরে তাবারি, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৬)। চারটি মাসের মধ্যে মহররম হিজরি বর্ষের প্রথম মাস। যা অত্যন্ত রহমত, বরকত ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের দশ তারিখ পবিত্র আশুরা। আশারা থেকে আশুরা। আশারা মানে দশ। মহররমের দশম দিবস।
সৃষ্টি জগতের সব মানুষের জন্য আশুরার দিনটি সবচেয়ে সম্মানিত ও পবিত্র। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন এবং প্রতিটি বিষয় পরিচালনা (করতে শুরু) করেন।’ (সূরা ইউনুস ১০ : আয়াত ৩)।
হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)কে শুক্রবার আসরের পর সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন (বস্তুত দিনটি ছিল, মহররম মাসের দশম তারিখ পবিত্র আশুরার দিন)।’ (মেশকাত শরিফ, পৃষ্ঠা ৫১০ ও মুসলিম শরিফ)।
আশুরার এ দিনটির মহিমা অসীম। বিশ্বের ইতিহাসে আশুরার দিনে অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়। দয়াময় আল্লাহ এ দিবসে যেমন হজরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেন, তেমনি তাকে বেহেশতে প্রবেশও করান, অতঃপর এ দিবসেই তাকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। আশুরার পবিত্র দিনে হজরত আদম (আ.)-এর অপরাধ ক্ষমা করা হয়।
এ দিনেই হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা চল্লিশ দিন পর মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল। পবিত্র আশুরার দিনেই হজরত ইবরাহিম (আ.) যেমন ভূমিষ্ঠ হন, তেমনি এ দিবসেই তিনি নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি পান। আর কলিজার টুকরা সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহর নামে কুরবানি করে এ দিবসেই ‘খলিলুল্লাহ’ বা আল্লাহর বন্ধু খেতাবে ভূষিত হন। আশুরার এ দিবসেই হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন।
হজরত ইদ্রিস (আ.)কে এ দিবসেই জান্নাতে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এ দিবসেই হজরত দাউদ (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেন এবং হজরত সোলায়মান (আ.) হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। এ দিবসেই হজরত ইউনুস (আ.) চল্লিশ দিন মাছের পেটে অবস্থান করার পর মুক্তি লাভ করেন। আশুরার এ দিবসেই হজরত ইয়াকুব (আ.) তার হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)কে চল্লিশ বছর পর ফিরে পান।
তখন হজরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন মিশরের বাদশাহ। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম হয়েছিল আশুরার দিনে এবং আল্লাহ পাক আসমানে তুলে নিয়েছিলেন এ দিনেই। এ পবিত্র দিবসেই ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশু মুসা (আ.)কে গ্রহণ করেন; আবার এ দিবসেই হজরত মূসা (আ.) স্বীয় অনুসারীদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। পক্ষান্তরে ফেরাউন সদলবলে সেখানে ডুবে মারা যায়। ইসলামের লালনভূমি হিসাবে মদিনার মাটি যেদিন দয়াল রাসূল (সা.)-এর পবিত্র পদস্পর্শ পেয়ে ধন্য হলো-সেদিন ছিল আশুরার দিন।
আশুরার দিনটি বিশ্ব মুসলিমের কাছে যে কারণে সবচেয়ে স্মরণীয় ও হৃদয়বিদারক তা হলো, ৬১ হিজরির এ দিনেই সাইয়্যেদুল আম্বিয়া হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, আমিরুল মুমিনিন শেরে খোদা হজরত আলী (রা.) ও খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.)-এর হৃদয়ের ধন, দয়াল রাসূল (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মাদী ইসলামের অকুতোভয় বীর সেনানী ইমাম হুসাইন (রা.) মাত্র ৭২ জন সহযোগী নিয়ে এজিদের ২২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে শাহাদতবরণের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের এক মহান আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে নির্মম ঘটনার সাক্ষী আশুরা।
মহররম মাস অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের শিক্ষা সঠিকভাবে নিজ জীবনে গ্রহণ করতে পারলে অসীম রহমত, বরকত ও কল্যাণ লাভ সম্ভব। এ মাসে অসৎ কাজের পরিণতি যেমন ভয়ানক, তেমনি সৎ কাজে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে পুরস্কার। জুলুম ও অন্যায়কে ঘৃণা করে প্রতিহত করার মাস মহররম। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের জীবনকে সহজ করে দেন, শান্তির চরিত্র গঠন করে সুন্দর পৃথিবীতে চলার পথ প্রসস্ত করে দেন। যেদিন তার কাছে ফিরে যাব, তার অবারিত রহমত যেন আমাদের সঙ্গে থাকে। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
শিক্ষাবার্তা /এ/০৪/০৭/২০২৫
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.